বাংলাদেশের ভোক্তারা বরাবরের মতোই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ওঠানামার প্রভাব অনুভব করছেন। এর মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে চলমান আলোচনা ও সিদ্ধান্তহীনতা সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। রমজানের মতো একটি সংবেদনশীল সময়ে এ ধরনের অনিশ্চয়তা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দামের হেরফেরের প্রভাব পড়ছে তাদের দৈনন্দিন জীবনে, আর সয়াবিন তেল এর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি উপাদান।
সয়াবিন তেলের দাম: সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও সরকারি সিদ্ধান্ত
বর্তমানে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত হয়নি। মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম ১৩ টাকা করে বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হলেও, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা মেনে নেয়নি।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান, এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি। আলোচনার মূল বিষয় ছিল বাজারে মূল্য স্থিতিশীল রাখা ও ব্যবসায়ীদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। আগামীকাল (৯ এপ্রিল) আবারও এ বিষয়ে বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে একটি সমাধান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব এবং সরকারের অবস্থান
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেও ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানাগুলোর মালিকেরা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁদের যুক্তি, আমদানির ওপর শুল্ক-কর অব্যাহতি শেষ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে এবং আগের দামে বিক্রি করে তারা লোকসানের মুখে পড়ছেন।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, শুল্ক-কর অব্যাহতি ৩০ জুন পর্যন্ত না বাড়ালে দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই। যদিও ট্যারিফ কমিশন এনবিআরকে রেয়াত বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে, এনবিআর থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।
অন্যদিকে, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, “ছয় মাস ধরে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সুযোগ দীর্ঘ সময় ধরে বজায় রাখা সম্ভব নয়।” তার মতে, এই কর রেয়াতের ফলে এনবিআর প্রায় ২,৫৮৬ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে, যা একটি বড় অঙ্ক।
বর্তমান বাজারমূল্য ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৭৫ থেকে ১৭৬ টাকা, ৫ লিটারের বোতল ৮৪৫ থেকে ৮৫০ টাকা, এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৫৭ থেকে ১৬৬ টাকা। পাম তেল ১৪৪ থেকে ১৫০ টাকা এবং সুপার পাম তেল ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে গত রমজানে তারা লোকসান দিয়ে তেল বিক্রি করেছেন। এ অবস্থায় নতুন করে দাম না বাড়ালে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তবে সাধারণ ভোক্তারা মনে করছেন, সরকারের উচিত হবে এই মুহূর্তে দাম না বাড়িয়ে মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা।
সরকারি কর্মকর্তারাও ব্যবসায়ীদের দাবিকে পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা। স্বর্ণের বাজার পরিবর্তন এর মতো, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামেও সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা দরকার।
বিশ্ববাজারের প্রভাব ও আমদানি শুল্ক
বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি কিছু দেশে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তেলের দাম সামান্য বেড়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশে পরোক্ষভাবে পড়ছে।
বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব ফেলছে আমদানি শুল্কও। শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়ায় বাজার কিছুটা স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই অব্যাহতি তুলে নেওয়ার পর পরিস্থিতি আবার অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। বিশ্ববাজারের প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সংকট
বর্তমান আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আস্থার সংকট রয়েছে। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, তাঁদের প্রস্তাব যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। অন্যদিকে, সরকার মনে করে, মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের আচরণ অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এই দ্বন্দ্বের সমাধান না হলে, বাজারে স্বাভাবিকতা ফিরবে না।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও সুপারিশ
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে স্বচ্ছ ও স্থায়ী মূল্যনীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। ট্যারিফ কমিশন ও এনবিআর-এর মধ্যে সমন্বয় থাকা চাই। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়েরই মঙ্গল হবে।
সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে বর্তমান যে টানাপোড়েন চলছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে সাধারণ জনগণের জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও গভীর হবে।
FAQs: সয়াবিন তেলের দাম
বর্তমানে সয়াবিন তেলের দাম কত?
বর্তমানে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৭৫ থেকে ১৭৬ টাকা এবং ৫ লিটারের বোতলের দাম ৮৪৫ থেকে ৮৫০ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল ১৫৭ থেকে ১৬৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সয়াবিন তেলের দাম কি বাড়ানো হয়েছে?
না, এখনো সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব দিলেও সরকার এখনো তা মেনে নেয়নি।
ভবিষ্যতে সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে পারে কি?
এটি নির্ভর করছে শুল্ক-কর অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হয় কিনা তার ওপর। যদি মেয়াদ না বাড়ে, তবে দাম বাড়তে পারে।
সরকার ভোজ্যতেলের দাম কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে?
সরকার ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমদানি শুল্ক হ্রাস করে এবং নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পেছনে মূল কারণ কী?
মূলত আমদানির ওপর শুল্ক-কর অব্যাহতি শেষ হওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে।
সাধারণ মানুষের জন্য এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব কেমন হবে?
মূল্যবৃদ্ধি হলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর তা বিরূপ প্রভাব ফেলবে। দৈনন্দিন খরচ বেড়ে যাবে, যা জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।