জুমবাংলা ডেস্ক : চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ উপকূলে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘চিটাগং সিটি আউটার রিং রোড’ নির্মাণ করেছে। সেই প্রকল্পের আওতায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য লাগানো হয় ফুলের গাছ। তৈরি করা হয় বাগান। সেসব নষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে দুই শতাধিক দোকান। আর প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে সেসব দোকান থেকে তোলা হচ্ছে চাঁদা।
এখানেই শেষ নয়, পতেঙ্গা সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকে বালুচরের দিকে নামতে ওয়াকওয়েতে বসানো হয়েছে নৌকা, দোলনাসহ ৮ থেকে ১০টি রাইড। সেখান থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে।
‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হকার ক্যামেরাম্যান শ্রমজীবী সমবায় লিমিটেড’ সমিতির ব্যানারে এসব স্থাপনা বসিয়ে প্রকাশ্যে চলছে এসব চাঁদাবাজি। আর এই চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন কথিত সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাসুদ করিম প্রকাশ কুত্তা মাসুদ। এই ধুন্ধুমার চাঁদাবাজির সঙ্গে স্থানীয় ট্যুরিস্ট পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগও উঠেছে।
সমুদ্র সৈকতকেন্দ্রিক এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে তথ্য জানতে অভিযুক্ত মাসুদ করিমকে ফোন করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ নানামুখী হুমকি পেয়েছেন চট্টগ্রামের এক সাংবাদিক। এই হুমকির মুখে নিরাপত্তহীনতায় বুধবার রাতে নগরের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগী।
অভিযুক্ত মাসুদ করিম পতেঙ্গা থানার দক্ষিণ পতেঙ্গা ফুলছড়ি পাড়ার বশর বলির বাড়ির নূর মোহাম্মদের পুত্র। এলাকায় ‘কুত্তা মাসুদ’ নামেও তার পরিচিতি আছে।
আর যে সাংবাদিককে হুমকি দেয়া হয়েছে তার নাম মোহাম্মদ রবিউল হোসেন। তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক নিউজ পোর্টাল সিভয়েস-২৪ এর স্টাফ রিপোর্টার।
সাধারণ ডায়েরিতে ভুক্তভোগী উল্লেখ করেন, অফিসে বসে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে অভিযুক্ত মো. মাসুদ করিমের কাছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে সরকারি জায়গা দখল করে দোকান নির্মাণের বিষয়ে জানতে চান তিনি। কথোপকথনের এক পর্যায়ে ভুক্তভোগীকে উকিল নোটিশ প্রদান এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ নানামুখী ভয়-ভীতি দেখান মাসুদ করিম।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) নগরের সাগরিকা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর উপকূলে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘চিটাগং সিটি আউটার রিং রোড’ নির্মাণ করেছে। সেই প্রকল্পের আওতায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য লাগানো হয় ফুলের গাছ। তৈরি করা হয় বাগান।
ওইসব গাছ ও বাগান নষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে দুই শতাধিক দোকান। প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হকার ক্যামেরাম্যান শ্রমজীবী সমবায় লিমিটেড’ সমিতির ব্যানারে দৈনিক দোকান ভেদে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয় একশ’ থেকে তিনশ’ টাকা। আর এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন ওই সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মাসুদ করিম প্রকাশ কুত্তা মাসুদ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসুদের বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় ২০১৫ সালের একটি চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। পতেঙ্গা সৈকত ঘিরে দোকান বাণিজ্যের পাশাপাশি তিনি টানেল রোডে ওই সমিতির ব্যানারে বানিয়েছেন মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। সেখানে মাইক্রোবাস প্রতি দৈনিক ১শ’ টাকা চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন সেখানে অন্তত ৫০টি মাইক্রোবাস টানেলে যাত্রী আনা-নেওয়া করে।
শুধু এসবই নয়, পতেঙ্গা সৈকতের মূল পয়েন্ট থেকে বালুচরের দিকে নামতে ওয়াকওয়েতে বসানো হয়েছে নৌকা, দোলনাসহ ৮ থেকে ১০টি রাইড। সেখান থেকে দৈনিক ৩০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এসবের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছেন এই মাসুদ করিম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সাংবাদিক মোহাম্মদ রবিউল বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের অবৈধ দোকানপাট নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পর্যটকরা অভিযোগ করে আসছিলেন। সেই ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের জন্য আমি সমুদ্র সৈকতে গিয়ে বেশ কিছু দোকানদার এবং পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলি।
‘জানতে পারি যে এসব নিয়ন্ত্রণ করেন মাসুদ করিম। সে অনুযায়ী তার বক্তব্য জানতে কল করি। তাকে এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সেসবের উত্তর না দিয়েই আমাকে নানা ধরনের ব্লেইম দিতে থাকেন।’
রবিউল বলেন, ‘এরপর তার মানহানি হয়েছে এবং আমি মানসিক টর্চার করছি উল্লেখ করে তিনি আমাকে উকিল নোটিশ পাঠাবেন এবং ভয়ে যেন সংবাদ প্রকাশ না করি সেজন্য মামলা করবেন বলে হুমকি দেন। কথোপকথনের সময় তিনি একাধিকবার আমার নীতি-নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, যা আমার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। পুলিশ প্রশাসনও তার এসব চাঁদাবাজির বিষয়ে ওয়াকিবহাল।’
পতেঙ্গা থানার ওসি কবিরুল ইসলাম সিভয়েস-২৪কে বলেন, ‘প্রশাসনের নামে এরকম চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু পতেঙ্গা সৈকতের ওখান থেকে থানা পুলিশ কোনো ধরনের টাকা নেয় না। আর আপনি যে সমিতির কথা বলছেন, আমার মনে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাদের কাগজপত্র যাচাই করা উচিত।’
ওসি আরও বলেন, ‘বীচ নিয়ে আসলে আমরা খুব ঝামেলার মধ্যে আছি। ওখানে মূলত তিনটি সিন্ডিকেট আছে যারা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় এবং ঝামেলা পাকাতে চায়। এটা নিয়ে আমাদেরও মাথাব্যথা আছে।
‘তাদের সঙ্গে এগুলোর বিষয়ে ডিসি স্যারসহ আমাদের কথা বলার কথা বৃহস্পতিবার। আর উচ্ছেদের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে কিন্তু তারা এসব করছে। আমি অনেককেই বলেছি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে, আমরা দায়ীদের গ্রেপ্তার করব।’
ওসি আরও বলেন, ‘আমি এই থানায় যোগদান করেছি অলমোস্ট তিন মাস। এই তিন মাসে একদিনও সিডিএ’র কাউকে দেখিনি। এই সময়ের মধ্যে সিডিএ বলেন বা সিটি করপোরেশন বলেন এই বীচ নিয়ে কারোরই কোনো মাথাব্যথা চোখে পড়েনি। যে যেমন পারছে বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়ে সেখানে চলছে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর বিভাগের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা সিভ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে টাকার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। যদি অন্য কারও থাকে এবং সেটার তথ্য-প্রমাণ যদি আমার পর্যন্ত আসে আমি তাকেও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসব।
‘আর মাসুদ নামে যার কথা বলছেন, সেটা ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক পত্রিকাতেই লিখেছে। আপনারা তা দেখেছেন। সে স্বঘোষিত। সে বীচের ওখানে চাঁদা নিয়ে সেখানকার লোকজনের জীবিকা নির্বাহে সহযোগিতা করে বা বীচের ময়লা পরিষ্কার করে।’
উপ-কমিশনার বলেন, ‘আসলে ওখানকার সব দোকানই অবৈধ। আমি তাদেরকে বলতে বলতে বিরক্ত। এরা পুরো বীচ এলাকাটার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলেছে। ওয়াকওয়েতে হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। দু’পাশেই দোকান করে রেখেছে। আমি আলাদাভাবে সিডিএ এবং করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সব দোকানপাট উচ্ছেদ করা হবে।’
সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করে দোকান নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী ও আউটার রিং রোডের প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বিন শামস্ সিভয়েস-২৪কে বলেন, ‘আমরা আগামী সপ্তাহে সেখানকার অবৈধ দোকানগুলো উচ্ছেদের জন্য একটা কর্মসূচি নিয়েছি। উচ্ছেদ করে পতেঙ্গা সৈকতে প্রথম পর্যায়ে যে ব্যবস্থাপনা ছিল তার চেয়েও ভালোভাবে ঢেলে সাজানো হবে। যেন দর্শনার্থীরা সেখানে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেভাবে অরাজকতা চলছে সেখানে স্থানীয় সিন্ডিকেট মিলে দোকান বসিয়েছে। ওখানে ট্যুরিস্ট পুলিশও আছে। তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো ছাড় নেই। সেখানে আমরা দুটি আন্তর্জাতিক মানের পাবলিক টয়লেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব শিগগির এসব বাস্তবায়ন করা হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. মাসুদ করিম বলেন, ‘হুমকির বিষয়টি মিথ্যা৷ প্রয়োজনে আপনি কল রেকর্ড শোনেন। সে (ভুক্তভোগী সাংবাদিক) আমার প্রতিপক্ষের প্ররোচনায় এসব করছে।’ সূত্র : নিউজবাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।