আতিক হাসান : সাপ নিয়ে নানা ধরনের গুজব রয়েছে। এগুলোর অন্যতম হলো, সাপ গরুর বাঁট থেকে দুধ খায়।
গরুর বাঁটে এমন কিছু চিহ্ন থাকে, যেগুলো থেকে যুগ যুগ ধরে এই ধারণা শিকড় গেড়েছে মানুষের মনে। গাঁয়ে যারা গরু পালন করে, তাদের চোখেই পড়ে এ চিহ্নগুলো।
প্রায়ই দেখা যায়, বাঁটের ওপর ছোট ছোট লালচে দাগ। অনেকেই মনে করে এগুলো সাপোর দাঁতের দাগ। আবার গরুর পেছনের পায়েও অনেক সময় সাপের আঁশর চিহ্ন পাওয়া যায়। অনেক গরুর দুধ কম হয়, দেখা যায় বাঁট শুকিয়ে আছে।
এগুলোর যেকোনো একটা লক্ষণ অথবা একসঙ্গে সবগুলো লক্ষণ দেখে অনেকেই ধরে নেন, রাতে সাপ এসে চুরি করে গরুর বাঁট থেকে দুধ খেয়ে গেছে।
আসলেই কি সত্যি? নাকি অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে?
প্রথমেই আসা যাক গরুর পেছনের পায়ে সাপের আঁশের চিহ্নের কথায়। এই চিহ্ন দেখে গৃহ্স্থ মনে করেন সাপ রাতে গরুর পা জড়িয়ে ধরে দুধ খেয়েছে। এভাবে সাপে যখন গরুর পা জড়িয়ে থাকে, গরু তখন নড়াচড়া করতে পারে না।
এ কারণেই সাপের আঁশের চিহ্ন তৈরি হয় গরুর পায়ে।
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া ভালো। সাপের আঁশের চিহ্ন গরুর পায়ে লেগে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সাপুড়ে সাপ নিয়ে খেলা দেখায়, তখন প্রায়ই দেখা যায়, সাপুড়ের হাত পেঁচিয়ে ধরেছে সাপ। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন, সাপুড়ের হাতে সাপের আঁশের কোনো চিহ্ন পড়েনি।
অন্যদিকে গরুর পা লোমে ঢাকা। এই ঘন লোমের ওপর সাপের আঁশের চিহ্ন পড়ার তো কোনো কারণই নেই। তবে সেটা বাঁধনের চিহ্নও হতে পারে। দেখা যায়, গরুর গোয়ালে একাধিক গরু অথবা ছাগল রাখা হয়। রাতে নড়াচড়া করতে গিয়ে অন্য গরুর বা ছাগলের দড়িতে গাভির পা জড়িয়ে যেতে পারে। তখন এ রকম বাঁধনের চিহ্ন হতে পারে পায়ে।
বাঁটের ওপরে ছোট ছোট লালচে যে দাগ দেখা যায়, সেগুলো তাহলে কী? সাপের দাঁতে লেগে এভাবে বাঁটে দাগ হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিষধর সাপ হলে তো কথাই নেই। সাপের দাঁত যদি বসে যায় বাঁটে, মারা পড়বে গরু। তাহলে এগুলো কিসের দাগ?
যারা গাঁয়ে গৃহস্থের দুধ দোহনের প্রক্রিয়াটা দেখেছেন, তারা নিশ্চয় এ-ও দেখেছেন, দুধ দোহনের পরে অনেকে বাঁট ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেন। কেউ কেউ তেলও লাগান। এর কারণ আছে। দুধ দোহনের পরে বাঁট পরিষ্কার না করলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। গরুর বাঁট ও এর আশপাশে ব্যাসিলাস মাইকোব্যাকটেরিয়াম নামের ব্যাকটেরিয়া জন্মায়। এ ছড়া কেনডিডা এপিডার্মোফাইটেন নামের ছত্রাকের সংক্রমণও হতে পারে। যারা নিয়মিত বাঁট পরিষ্কার করেন, তাদের গরুর বাঁটে এ ধরনের দাগ দেখা যায় না। আর মনে রাখতে হবে, সরিষার তেল অনেক সময় জীবাণুনাশকের মতো কাজ করে। কিন্তু যারা দুধ দোহনের পর গরুর বাঁট ঠিকমতো পরিষ্কার করেন না, তাঁদের গরুর বাঁটে এ ধরনের ছোট ছোট দাগ দেখা যায়। এটাকে সাপের দাগ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
এখন কেউ হয়তো বলতে পারেন, সাপ তো বাঁট থেকে দুধ খেতেও পারে! তাদের বলছি, সাপ বাঁট থেকে দুধ চুষে খেতে পারে না। এভাবে বাঁট থেকে দুধ চুষে খাওয়ার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত ঠোঁট ও জিভ থাকতে হয়। সাপের জিভ স্তন্যপায়ী প্রাণীর জিভের মতো নয়। এর জিভ সরু ও চিকন। এই জিভ দিয়ে কখোনেই বাঁট থেকে দুধ চুষে খাওয়া সম্ভব নয়।
তা ছাড়া তরল চুষে খেতে হলে মুখের এবং বুকের ভেতরকার চাপ হঠাৎ অনেকটা কমিয়ে ফেলতে হয়। মানুষের বেলায় বুক ও পেটের মাঝখানে মধ্যচ্ছদা নামের পর্দা থাকে। মধ্যচ্ছদা নিচের দিকে নেমে গিয়ে বুকের ভেতরকার চাপ অনেকটা কমিয়ে দেয়। ফলে মানুষ জিভ দিয়ে চুষে দুধ খেতে পারে।
কিন্তু সাপের কোনো মধ্যচ্ছদা নেই। এ জন্য সাপের পক্ষে কোনো কিছু জিভ দিয়ে চুষে খাওয়া সম্ভব নয়। ফলে সাপ গরুর বাঁট থেকে দুধ চুষে খাওয়ার কোনো উপায় নেই সাপের।
মাঝে মাঝে তাহলে গরুর বাঁট শুকিয়ে থাকে কেন? শুকিয়ে থাকা বা চুপসে থাকার বিষয়টাকে বলে প্রতিবর্ত। প্রতিবর্ত হলে জীবের এমন একটা শারীরিক বৈশিষ্ট্য, যা অনেকটাই জীবের অজান্তেই ঘটে। ভয় পেলে যেমন মানুষ ঘেমে ওঠে, নিজের অজান্তেই গরুও তেমনি সাপের ভয় পায়। সেটা সাপের ভয়েই হতে পারে। অনেক সময় গৃহস্থ দেখতে পান, সকালে সাপ গোয়াল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তখনই হয়তো খেয়াল করেন, গুরুর বাঁট চুপসে আছে।
এরও ব্যাখ্যা আছে। সাপ শীতল রক্তের প্রাণী। এরা পরিবেশের তাপমাত্রা অনুযায়ী শরীরের তাপমাত্রা পরিবর্তন করতে পারে না। তাই শীতকালে একটু উষ্ণতার খোঁজে অনেক সময় গোয়ালে আশ্রয় নেয়। কারণ গোয়ালে খড়কুটো রাখে মানুষ, তারপর শীতকালে গোয়াল উষ্ণ রাখার জন্য ছাই ছিটিয়ে দেন। গরমে গোয়ালে ইঁদুরের উপদ্রব হয়। সাপ ইঁদুরে পিছু নিয়ে গোয়ালে এসে আশ্রয় নিতে পােরে।সেখানে উষ্ণতা খুঁজতে চায় গরু। সাপ দেখে গরু ভয় পেয়ে যায়। তখন অজান্তেই বাঁট সংকুচিত হয়ে যায়।
আরেকটা কথা বলা জরুরি। স্তন্যপায়ী প্রাণী ছাড়া আর কোনো প্রাণীর শরীর দুধ খাওয়ার উপযোগী নয়। সাপের শরীর দুধ হজম করতে পারে এমন কোনো প্রমাণও নেই। তবে পানির দরকার হয়, সাপ পানি পান করতে পারে। দুধ খায় এমন কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত মেলেনি। বাঁট চুষে দুধ পান করা তো সাপের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়।
সূত্র : প্রাণিবিজ্ঞান/ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।