শুরু থেকে ডা. সাবরিনাকে জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান বলা হলেও তদন্ত সংস্থা বলছে, প্রতিষ্ঠানটির আহ্বায়ক হিসেবেই জাল-জালিয়াতিতে তার সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। মামলার অন্য আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও প্রতারণার নেপথ্য নাম হিসেবে উচ্চারিত হয়েছে ডা. সাবরিনার কথা।
ডিবির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডা. সাবরিনাসহ আসামিদের বিরুদ্ধে দ্রুত চার্জশিট দেয়া হবে। আর এ মামলায় যে শাস্তি হয়, সাবরিনা ও তার সহযোগীদের জন্য তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হবে বলে জানাচ্ছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ এনে গত ২৩ জুন তেজগাঁও থানায় মামলাটি দায়ের করেন কামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। মামলায় পেনাল কোডের ১৭০/২৬৯/৪২০/৪০৬/৪৬৬/৪৭১/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে একাধিক ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড।
সেজন্য আইনজীবীরা বলছেন, অভিযোগ প্রমাণ হলে ডা. সাবরিনার সাত বছরের কারাদণ্ডও হতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তাদের সর্বোচ্চ তৎপরতা চেষ্টার কথাই বলছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের অতিরিক্তি পাবলিক প্রসিকিউর (এপিপি) হেমায়েত উদ্দিন খান হিরন বলেন, ডা. সাবরিনা একজন প্রতারক হিসেবে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি প্রতারণা করে অনেক মানুষকে বিপদে ফেলেছেন। মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলেছেন। তার বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা করা হয়েছে তার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের জেল। তার যেন সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয় আমরা সে দিকে নজর রাখবো।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, মামলা তদন্তে জেকেজির চেয়ারম্যান নয়, আহ্বায়ক হিসেবে ডা. সাবরিনা চৌধুরীর সম্পৃক্ততা পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আশা করছি এ মামলায় আমরা দ্রুতই চার্জশিট দিতে পারব। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার পদে থাকার কোনো ডকুমেন্ট আমরা পাইনি। তবে আহ্বায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত থাকার কাগজ পাওয়া গেছে।
মামলার বাদী কামাল হোসেন বলেন, আমরা জেকেজি হেলথকেয়ারে গিয়ে করোনা পরীক্ষা করে প্রতারিত হয়েছি। তাই আমি বাদী হয়ে একটি মামলা করেছি। দোষীরা শাস্তি পাক এটা আমি চাই। ডা. সাবরিনাসহ মামলার অপর আসামিরা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। তাদের বিচার হওয়া উচিত।
ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় যে শাস্তি
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১৭০/২৬৯/৪২০/৪০৬/৪৬৬/৪৭১/৩৪ ধারায় যে মামলা হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। এছাড়া আরও নানা শাস্তি রয়েছে।
মামলার ১৭০ ধারা মোতাবেক, ‘ভুয়া সরকারি কর্মচারী বলিয়া পরিচয় দেয়া যদি কোনো সরকারি কর্মচারী হিসেবে কোনো বিশেষ সম্পত্তি ক্রয় বা ক্রমের জন্য দরকষাকষি না করতে আইনতঃ বাধ্য থাকা সত্ত্বেও নিজের নামে অথবা অন্য কারও নামে অথবা যুক্তভাবে অথবা অন্যান্যের সাথে অংশ নিয়ে উক্ত সম্পত্তি ক্রয় করেন বা ক্রয় করার জন্য দরকষাকষি করেন, তবে তিনি দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের বিনাশ্ৰম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন; এবং সম্পত্তিটি ক্রয় করা হয়ে থাকলে তা বাজেয়াপ্ত হবে।’
২৬৯ ধারা মোতাবেক, ‘কোনো কার্য দ্বারা জীবনের পক্ষে বিপজ্জনক কোনো রোগের সংক্রমণ ছড়াইতে পারে জানিয়াও অবহেলাবশতঃ উহা করা কোনো ব্যক্তি যদি বেআইনিভাবে বা অবহেলামূলকভাবে এমন কোনো কার্য করে যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোনো রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও তা করে, তবে-সেই ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থদণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’
৪২০ ধারা মোতাবেক, ‘প্রতারণা ও সম্পত্তি সমর্পণ করিবার জন্য অসাধুভাবে প্রবৃত্ত করা কোনো ব্যক্তি যদি প্রতারণা করে এবং অসাধুভাবে অপর কোনো ব্যক্তিকে কোনো সম্পত্তির অংশ বা অংশবিশেষ প্রণয়ন, পরিবর্তন বা বিনাশ সাধনে প্রবৃত্ত করে অথবা অসাধুভাবে প্রতারিত ব্যক্তিকে এমন কোনো স্বাক্ষরিত বা সিল মোহরযুক্ত বস্তুর সমুদয় অংশ বা অংশবিশেষ প্রণয়ন পরিবর্তন বা বিনাশ সাধনে প্রবৃত্ত করে যা মূল্যবান জামানতে রূপান্তরযোগ্য, তবে উক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রমের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদেওও দণ্ডিত হবে।’
৪০৬ ধারা মোতাবেক, ‘কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে, তবে সে ব্যক্তি তিন বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্ৰম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থদণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’
৪৬৬ ধারা মোতাবেক, ‘আদালতের নথিপত্র বা সরকারি রেজিস্টার ইত্যাদি জালকরণে কোনো ব্যক্তি যদি এমন একটি দলিল জাল করে যা কোনো বিচারালয়ের নথি অথবা প্রসিডিং কিংবা কোনো বিচারালয়ে উত্থাপিত নথি বা প্রসিডিং বলে অথবা কোনো জন্ম, খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিবাহ কিংবা সমাধিকরণের রেজিস্টার বলে অথবা কোনো সরকারি কর্মচারী কর্তৃক সরকারি কর্মচারী হিসেবে রক্ষিত রেজিস্টার বলে অথবা কোনো সরকারি কর্মচারী দ্বারা তার সরকারি পদমর্যাদা বলে কৃত সার্টিফিকেট বা দলিল বলে, অথবা কোনো মামলা দায়ের করার বা উহাতে পক্ষ সমর্থনের কিংবা উহাতে কোনো কার্যক্রম গ্রহণের রায় মানার কিংবা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বলে প্রতিভাত হয়, তবে উক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম কিংবা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবে।’
৪৭১ ধারা মোতাবেক, ‘কোনো ব্যক্তি যদি প্রতারণামূলকভাবে বা অসাধুভাবে এমন একটি দলিলকে খাঁটি দলিল হিসাবে ব্যবহার করে, যে দলিলটি একটি জাল দলিল বলে সে জানে বা তার বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে, তবে সে ব্যক্তি যেন সে নিজে দলিলটি জাল করেছে, এমনভাবে দণ্ডিত হবে।’
দুই দফা রিমান্ড শেষে গত ২০ জুলাই ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে সাবরিনাকে হাজির করে পুলিশ। তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডা. সাবরিনাকে জেলহাজতে আটক রাখা একান্ত প্রয়োজন। তার নাম ঠিকানা যাচাই করা হয়নি বিধায় ডা. সাবরিনা জামিনে গেলে চিরতরে পলাতক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, ‘রিমান্ডে থাকাবস্থায় সাবরিনাকে দফায় দফায় মামলার বিষয়ে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি মামলা সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। যা যাচাই-বাছাই চলছে। সাবরিনা তার সহযোগীদের (যাদের অনেকে আসামি) নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের পজিটিভ ও নেগেটিভ রিপোর্ট সরবরাহ করেছিলেন। নিরীহ লোকদের টাকা আত্মসাৎ এবং অবহেলার মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ বিস্তারে সহায়তা করে আসছিলেন সাবরিনা। তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রভাব খাটিয়ে স্বামী আরিফুল চৌধুরীর জেকেজি হেলথকেয়ারকে বিভিন্ন সরকারি কাজের আদেশ পাইয়ে দিতেন। ফলে জেকেজি হেলথকেয়ার বেপরোয়াভাবে সমাজের ক্ষতিসাধন করে এবং বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।’
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘ডা. সাবরিনা তার অপরাপর সহযোগীদের সহায়তায় করোনাভাইরাস মহামারির সময় অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে সমাজবিরোধী এবং ধবংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিলেন। ডা. সাবরিনার প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথকেয়ার ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার সংক্রমিত রোগীদের টাকার বিনিমিয় স্যাম্পল কালেকশন করে তা পরীক্ষা না করে হাজার হাজার ভুয়া সার্টিফিকেট (নেগেটিভ/পজিটিভ) দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে। এছাড়া বিদেশগামী বাংলাদেশি নাগরিকদের যাত্রার আগে জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে করোনাভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট দেয়া হয়, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে মিথ্যা মর্মে প্রমাণিত হয়েছে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।’
‘মামলায় গ্রেফতার আসামি বিপ্লব দাস, মামুনুর রশীদ, হুমায়ূন কবির হিমু, তানজিলা পাটোয়ারী, আরিফুল চৌধুরী ও সাদি চৌধুরীর নিকট থেকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জাল সার্টিফিকেট (নেগেটিভ/পজিটিভ) উদ্ধার করা হয়। ডা. সাবরিনা জেকেজি হেলথ কেয়ারের অফিসে রক্ষিত ল্যাপটপ ও অন্যান্য ডিভাইসের মাধ্যমে সরকারি লোগো ব্যবহার করে জাল সার্টিফিকেট দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। মামলার এজহারনামীয় আসামি তানজিলা পাটোয়ারী ও হুমায়ূন কবির হিমু নিজেদের জবানবন্দিতে ডা. সাবরিনার নাম প্রকাশ করেছেন এবং তারা সাবরিনার জাল-জালিয়াতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই শেষ মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের নিমিত্তে প্রয়োজনে আবার তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হবে’—বলা হয় প্রতিবেদনে।
গত ১২ জুলাই দুপুরে সাবরিনাকে তেজগাঁও বিভাগীয় উপ-পুলিশ (ডিসি) কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা না করেই ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে তেজগাঁও থানায় করা মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ১৩ জুলাই তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। ১৭ জুলাই আরও দুদিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি। দুই দফা রিমান্ড শেষে ২০ জুলাই তাকে কারাগারে পাঠান আদালত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।