বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম কেবল ক্ষমতার জন্য নয়, বরং অবস্থানের দৃঢ়তার জন্য স্মরণীয়। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম—যাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় শব্দ “আপসহীন নেত্রী”। প্রশ্ন হলো, এই পরিচয় কি কেবল রাজনৈতিক স্লোগান, নাকি দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাস্তবতা? সামরিক শাসনের বিরোধিতা থেকে শুরু করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, কারাবাস থেকে অসুস্থতার মধ্যেও আপস না করার সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই এই “আপসহীন নেত্রী” উপাধিকে শক্ত ভিত দিয়েছে।
ব্যক্তিগত শোক থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত: নেতৃত্বে আসার কঠিন যাত্রা
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া নিজেকে আবিষ্কার করেন গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে। রাজনীতিতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও, দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তাকে নিতে হয় জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত।
এরশাদের সামরিক শাসনের দমনমূলক পরিবেশে ১৯৮৪ সালে বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ ছিল সহজ কোনো পথ নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্তই ছিল তার আপসহীন মানসিকতার প্রথম স্পষ্ট প্রকাশ।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন: সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান
১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সংগঠিত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ৭-দলীয় জোট। এই জোটের প্রধান মুখ ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৭—এই তিন দফা গ্রেপ্তার ও কার্যত গৃহবন্দী অবস্থার মধ্যেও তিনি আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। সামরিক সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় না যাওয়াই ছিল তার রাজনৈতিক কৌশলের মূল ভিত্তি। এখান থেকেই তাকে স্বৈরশাসনবিরোধী আপসহীন নেত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয়।
১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান: গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন নেতৃত্ব
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন অন্যতম প্রধান নেতৃত্বের মুখ। এই সময় অনেক সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব এলেও তিনি ক্ষমতার ভাগাভাগি বা গোপন সমঝোতার পথে যাননি।
চূড়ান্তভাবে এরশাদের পতন ঘটে, এবং দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত হয়—যা তার কঠোর অবস্থানের রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হয়।
১৯৯১ নির্বাচন ও সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। তার নেতৃত্বেই দেশ আবার সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে।
রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো বদলের এই সিদ্ধান্তকে অনেক বিশ্লেষক গণতন্ত্র পুনর্গঠনে তার দৃঢ় ও আপসহীন রাজনৈতিক অবস্থানের ফল হিসেবে দেখেন।
২০০১–২০০৬: ক্ষমতায় থেকেও কঠোর রাজনৈতিক রেখা
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তার শাসনামলে তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ, জোটগত চাপ এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েন। বিরোধীদের অভিযোগ ও কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি নীতিগত প্রশ্নে সহজ সমঝোতায় যাননি। এই সময়েই তার রাজনৈতিক চরিত্রে কঠোরতা ও সিদ্ধান্তে অনমনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২০১৩–২০১৮: কারাবাস ও অসুস্থতার মধ্যেও আপসহীনতা
২০১৩ ও ২০১৫ সালের রাজনৈতিক সংকটে সরকার ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে সংলাপ ও সমঝোতার চাপ এলেও বিএনপি জানায়—আপস তাদের রাজনৈতিক নীতি নয়।
২০১৮ সালে দুর্নীতি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দি অবস্থায়, গুরুতর অসুস্থতার মধ্যেও তিনি কোনো বিকল্প রাজনৈতিক সমঝোতা গ্রহণ করেননি। এই অধ্যায় তার “আপসহীন” পরিচয়কে আরও দৃঢ় করে তুলেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।


