কোথাও এক গ্রামের মেঠোপথে হাঁটছেন রোজিনা। পিঠে চাপানো ভারী ব্যাগে শুধু ওষুধপত্র নয়, অসহায় মানুষের জন্য আশার বাণীও বয়ে বেড়ান তিনি। একইসঙ্গে রাজধানীর অলিগলিতে রাফি নামের এক তরুণ প্রতিবন্ধী শিশুর হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে নামেন। এরা কেউ বিখ্যাত নন, কিন্তু এঁদের হাত ধরেই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠছে নতুন সমাজের ভিত। সামাজিক কাজ শুধু সহানুভূতির প্রকাশ নয়, এটি একটি সমাজ বদলের হাতিয়ার, যার শিকড় প্রোথিত রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে, মানবিকতায়। যখন স্বেচ্ছাসেবকেরা ঝুঁকিপূর্ণ জলবায়ু অভিবাসীদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেন, বা নারী নির্যাতনের শিকারদের আইনি সহায়তা দেন, তখন তা কেবল একজনকে সাহায্য করা নয়—গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক নীরব বিপ্লব। এই লেখায় আমরা খুঁজে বের করব, কীভাবে সামাজিক কাজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করছে, এবং কেন এটি আমাদের জাতীয় অগ্রগতির অপরিহার্য ইঞ্জিন।
Table of Contents
সামাজিক কাজের গুরুত্ব: সমাজ বদলের হাতিয়ার—একটি প্রাণবন্ত সংজ্ঞা
সামাজিক কাজ মানে শুধু ত্রাণ বিতরণ নয়, এটি একটি কাঠামোগত রূপান্তরের দর্শন। বাংলাদেশে যেখানে ২৪% মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন (বিবিএস ২০২৩), সেখানে সমাজকর্মীরা কেবল উপসর্গ নয়, মূল কারণের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ভাবুন তো, কুড়িগ্রামের বন্যাপীড়িত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দলটি শুধু খাবার পৌঁছে দেয়নি—স্থানীয় যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেছে ‘জলবায়ু প্রতিরোধী কৃষি কোর্স’, যা প্রথাগত চাষাবাদ পদ্ধতিকে বদলে দিচ্ছে। এখানেই সামাজিক কাজের প্রকৃত শক্তি: এটি সমস্যাকে স্থায়ী সমাধানে রূপান্তরিত করে।
গুরুত্বপূর্ণ দিক:
- ক্ষমতায়নের হাতিয়ার: ময়মনসিংহের নারী সমবায় সমিতির উদাহরণ নিন। সামাজিক সংগঠনগুলির সহায়তায় ৫০০ নারী ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন। আজ তারা শুধু স্বাবলম্বী নন, গ্রামের অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
- অসমতা দূরীকরণ: ঢাকার কাওরান বাজারে শিশুশ্রমিকদের উদ্ধারে ‘আলোকযাত্রা ফাউন্ডেশন’-এর কাজ সামাজিক ন্যায়ের নতুন মাপকাঠি তৈরি করেছে।
- সামাজিক সংহতি: রোহিঙ্গা শিবিরে বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবক ও রোহিঙ্গাদের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘শান্তি বাগান’ সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশে সামাজিক কাজের ঐতিহাসিক ভিত্তি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ শুধু চিকিৎসা সেবাই দেয়নি, যুদ্ধাহতদের পুনর্বাসনে যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, তা আজ ‘সেবা’-র মতো সংস্থার প্রেরণা। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ২৮,০০০ এনজিও শুধু সংখ্যা নয়—এরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরিবর্তনের বীজ বুনে চলেছে। বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন এর তথ্য অনুসারে, দেশের ৮৭% উপজেলায় স্থানীয় সংগঠনগুলি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুরক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখছে।
সামাজিক কাজের বিবর্তন: মুক্তিযুদ্ধ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ
১৯৭১-পরবর্তী সময়ে সামাজিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পুনর্গঠন: ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘরবাড়ি, হতাশা থেকে আশা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে মাইক্রোক্রেডিট বিপ্লব (গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল) অর্থনৈতিক সামাজিক কাজের নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। আর আজ? ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে সামাজিক কাজও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়েছে। ভাবুন তো, ‘জাগো ফাউন্ডেশন’-এর ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ গ্রামীণ তরুণদের কোডিং শিখিয়ে আউটসোর্সিংয়ে যুক্ত করছে—এটি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বিত হাতিয়ার।
পরিবর্তনের মাইলফলক:
- আইনি সংস্কার: সালিশ ও মেডিয়েশনের মাধ্যমে গ্রামীণ ন্যায়বিচার (বরিশালের ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর মডেল)।
- জলবায়ু অভিযোজন: সুন্দরবন অঞ্চলে ‘উবিনীগ’-এর নেতৃত্বে লবণাক্ততা-সহিষ্ণু ধান চাষের প্রচলন।
- মানসিক স্বাস্থ্য: ‘মনোযোগ ফাউন্ডেশন’-এর হেল্পলাইন (০৮-০০০-৮৮৮-০০০) প্রতিদিন শতাধিক যুবকের আত্মহত্যাপ্রবণতা রোধ করছে।
বর্তমানে সামাজিক কাজের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো টেকসই অর্থায়ন ও রাজনৈতিক সমর্থন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি বাজেটে সমাজসেবা খাতের বরাদ্দ মোট বাজেটের মাত্র ১.২% (আর্থিক মন্ত্রণালয়, ২০২৩)। অথচ গবেষণা বলে, সামাজিক বিনিয়োগের প্রতিটি টাকা অর্থনীতিতে ৭ গুণ ফেরত দেয়! আমাদের আরেকটি নিবন্ধে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
সামাজিক কাজের প্রাত্যহিক প্রভাব: গল্প যারা বদলাচ্ছে
মেহেরুন নেসা, কক্সবাজারের এক মৎস্যজীবী পরিবারের মেয়ে। সমুদ্রসীমা বেড়ে যাওয়ায় বাবার রোজগার কমে গিয়েছিল। স্থানীয় সংগঠন ‘Coastal Association for Social Transformation (COAST)’-এর প্রশিক্ষণে মেহেরুন নোনাজলিতে চিংড়ি চাষ শেখেন। আজ তিনি শুধু স্বাবলম্বী নন, ৩০ জন নারীকে একই পথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখানে সামাজিক কাজ শুধু একটি পেশা নয়—নারী ক্ষমতায়নের রাজপথ।
আরিফুল ইসলাম নামের একজন সিনিয়র সিটিজেন ঢাকার মিরপুরে একা থাকতেন। ‘সমাজ সেবা সংস্থা’-র স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়মিত তার সাথে সময় কাটান, ওষুধপত্র দেন। কিন্তু এর চেয়েও বড় কথা—তাকে ‘বয়স্ক নাগরিক ফোরাম’-এর সাথে যুক্ত করে সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি সামাজিক কাজের মানবিক মাত্রা: সম্মান ও অন্তর্ভুক্তি।
পরিসংখ্যানে প্রমাণ:
- স্বাস্থ্য: ব্র্যাকের কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের কারণে গ্রামাঞ্চলে শিশুমৃত্যুর হার ২০০০-২০২৩ সময়ে ৪৩% কমেছে (ইউনিসেফ রিপোর্ট)।
- শিক্ষা: ‘এসো পড়ি’ অভিযানের ফলে ঝরেপড়া শিশুদের ভর্তির হার ৬৮% বৃদ্ধি (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর)।
- লিঙ্গসমতা: নারী নির্যাতন বিরোধী হেল্পলাইন ১০৯-এ প্রতিমাসে ১২,০০০ কল, যা আইনি সহায়তার চাহিদা প্রমাণ করে।
সামাজিক কাজের ভবিষ্যৎ: টেকসই উন্নয়নের নীলনকশা
২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সামাজিক কাজ কৌশলগত অংশীদার। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে এর ভূমিকা অপরিহার্য। ভবিষ্যতের সামাজিক কাজের কয়েকটি ট্রেন্ড:
- প্রযুক্তির সমন্বয়: মানচিত্রায়ন সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা চিহ্নিতকরণ।
- যুব নেতৃত্ব: ‘ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’-এর মতো সংগঠনের মাধ্যমে তরুণদের অংশগ্রহণ।
- পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ: বেসরকারি সংস্থার সাথে সরকারি সংস্থার সমন্বয় (যেমন: ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাথে ‘প্রাণ’-এর খাদ্য বিতরণ প্রকল্প)।
বড় চ্যালেঞ্জ হলো ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কার। উত্তরবঙ্গের কিছু অঞ্চলে নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘অশুচি’ বলা হয়। এগুলো মোকাবিলায় প্রয়োজন সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা।
আপনার ভূমিকা: কীভাবে শুরু করবেন?
সমাজ বদলানো যুদ্ধে আপনি একা সৈনিক নন—সম্মিলিত প্রচেষ্টাই সাফল্যের চাবিকাঠি। শুরু করুন ছোট্টভাবে:
- স্থানীয় সংগঠনে যোগ দিন: ‘স্বপ্নের পাঠশালা’ বা ‘জাগরণী চক্র’-র মতো স্থানীয় গ্রুপ খুঁজুন।
- দক্ষতা ভাগ করুন: আপনি যদি ডাক্তার, শিক্ষক বা আইটি বিশেষজ্ঞ হন, বিনামূল্যে কর্মশালার আয়োজন করুন।
- অর্থসাহায্য: বিশ্বাসযোগ্য সংস্থাকে নিয়মিত দান (BRAC, JAAGO Foundation ইত্যাদি)।
- সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাম্বাসেডর: সামাজিক সমস্যা নিয়ে সচেতনতামূলক কন্টেন্ট শেয়ার করুন।
সামাজিক সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবক হবার গাইডলাইন সম্পর্কে আমাদের বিশেষ নিবন্ধে বিস্তারিত পাবেন।
সামাজিক কাজ কোনও উপকরণ নয়, এটি একটি সংস্কৃতি—যার মূলে আছে সহমর্মিতা, সংগঠন ও স্থায়িত্বের দর্শন। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, শহর, মানুষ যখন সামাজিক কাজকে সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করবেন, তখনই জন্ম নেবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমৃদ্ধশালী জাতি। আজই সিদ্ধান্ত নিন: আপনি এই ইতিহাসের অংশ হতে চান কি? আপনার হাতের ছোঁয়ায় হয়তো একটি শিশুর ভবিষ্যৎ আলোকিত হবে, একটি বৃদ্ধের চোখে ফিরবে আস্থা। সময় এসেছে জেগে উঠবার—সমাজকে বদলাবার এই মহান যাত্রায় শামিল হোন।
জেনে রাখুন
১. সামাজিক কাজ ও স্বেচ্ছাসেবার মধ্যে পার্থক্য কী?
সামাজিক কাজ একটি পেশাদারী ও একাডেমিক শাখা, যার নীতিমালা ও পাঠ্যক্রম রয়েছে। অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবা যেকোনো ব্যক্তি সামাজিক কল্যাণে অংশ নিতে পারেন। পেশাদার সমাজকর্মীরা গবেষণা, নীতিনির্ধারণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাঠামোগত পরিবর্তনে কাজ করেন, যা স্বেচ্ছাসেবার চেয়ে বিস্তৃত।
২. সামাজিক কাজ কীভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণে সাহায্য করে?
সামাজিক কাজ দারিদ্র্যের মূল কারণ যেমন—শিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের ঘাটতি বা বৈষম্য—সেগুলো সমাধানে কাজ করে। ক্ষুদ্রঋণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বা কৃষি উপকরণ বিতরণের মাধ্যমে টেকসই আয়ের উৎস সৃষ্টি করে, যা ভিক্ষা বা ত্রাণের চেয়ে কার্যকর।
৩. বাংলাদেশে সামাজিক কাজ পড়াশোনার সুযোগ কোথায়?
বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগ রয়েছে। এছাড়া ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। এই বিষয়ে পড়ে পেশাদার সমাজকর্মী হওয়া যায়।
৪. সামাজিক সংগঠনে অর্থসাহায্য করলে কি ট্যাক্স ছাড় পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ সরকার এনজিও বিষয়ক ব্যুরো (Bureau of NGO Affairs) থেকে অনুমোদিত সংস্থাকে দান করলে আয়কর আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী ট্যাক্স ছাড়ের সুযোগ রয়েছে। দাতাকে সংস্থার করমুক্ত সার্টিফিকেট (Tax Exemption Certificate) জমা দিতে হবে।
৫. সামাজিক কাজে জড়িত হতে কোন দক্ষতাগুলো গুরুত্বপূর্ণ?
সহানুভূতি, ধৈর্য ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা অপরিহার্য। এছাড়া যোগাযোগ দক্ষতা, দলগতভাবে কাজ করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের কৌশল এবং ডিজিটাল লিটারেসি (সোশ্যাল মিডিয়া, ডেটা এন্ট্রি) সামাজিক কাজকে অধিক কার্যকর করে।
৬. যুবকেরা কীভাবে সামাজিক কাজে নতুন ধারণা যোগ করতে পারে?
তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট (যেমন: রক্তদান প্ল্যাটফর্ম), আর্ট অ্যাক্টিভিজম (স্টিট আর্ট, নাটক) বা ক্লাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক কাজকে উদ্ভাবনী রূপ দিতে পারে। এতে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা দূর হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।