জুমবাংলা ডস্ক : বাংলা সিনেমার এক সময়ের মধ্যমণি সালমান শাহের মৃত্যুর পেছনে অদৃশ্য ছায়া হিসেবে বার বার উঠে এসেছিল আলোচিত ব্যবসায়ী ও প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম। ভক্তদের ধারণা ছিল, সালমানের মৃত্যুর পেছনে ‘আজিজ ভাইয়ের’ হাত আছে।
তবে সালমান শাহ হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআিই) বলছে, এ মামলায় ১৬১ ধারায় সাক্ষি দেওয়া ৪০ জনের মধ্যে কেউই আজিজ ভাইয়ের নাম নেননি।
সোমবার পিবিআই সদরদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এ তথ্য জানান।
‘এছাড়া সাক্ষ প্রমাণে কেউই বলেনি তিনি (আজিজ ভাই) সালমানের ইস্কাটনের বাসায় যেতেন। তাই আমাদের মনে হয়েছে এ ঘটনায় তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে সাক্ষিরা বলেছে সিনেমা সংশ্লিষ্ট অনেকেই তার বাসায় যাতায়াত করতেন।’ যোগ করেন বনজ কুমার।
তিনি আরও বলেন, তার (সালমান শাহ) আত্মঘাতি হওয়ার পেছনে সে নিজেই দায়ী। প্ররোচনার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। আমারা যে সকল কারণ পেয়েছি তা থেকে প্ররোচনা দেয়ার মত কাউকে খুঁজে পাই নাই।
‘সালমানের মানসিক কোনো সমস্যা ছিল কি না’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তেমন কিছু পাই নাই। সে সময় এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হতো না। তবে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, সে অনেক অভিমানি ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই তার বন্ধুদের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে সে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখত। আমরা কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখেছি সালমানের মানসিক সমস্যা নিয়ে কখনো চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়নি। এমন কোনো কাগজও আমরা হাতে পাইনি।’
সালমান শাহ আত্মহত্যার পেছনে পিবিআইয়ের ৫ কারণ :
পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমেদের স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তিতে নায়ক সালমানের আত্মহত্যার পাঁচটি কারণ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হচ্ছে-
১. সালমান শাহ ও চিত্রনায়িকা শাবনূরের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা;
২. স্ত্রী সামিরার সঙ্গে সালমানের দাম্পত্য কলহ;
৩. সালমান শাহর মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা এবং একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়া বা আত্মহত্যার চেষ্টা করা;
৪. মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা এবং জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জিভূত অভিমানে রূপ নেয়া;
৫. সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনের অপূর্ণতা।
সালমান শাহ একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন
সালমান শাহ একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন, বলে জানান পিবিআই প্রধান।
তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে পিবিআই তদন্ত শুরু করে। মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জবানবন্দি গ্রহণ করতে সময়টা বেশি লেগেছে। ১৬৪ ধারায় ১০ জনের জবানবন্দি নিয়েছে পিবিআই। এছাড়া রয়েছে আরও কয়েকজনের সাক্ষ্য। নতুন করে আলামত হিসেবে একটি ফ্যান জব্দ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই ফ্যানেই আত্মহত্যা করেছিলেন সালমান।’
বিউটি পার্লারের রাবেয়া সুলতানা রুবি
কিছুদিন আগে ফেসবুকে এক ভিডিও প্রকাশ করে সালমানের মৃত্যুর রহস্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন সালমানের বাসার পাশেই বিউটি পার্লারে কাজ করা রাবেয়া সুলতানা রুবি। সেখানে তিনি দাবি করেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি। তাকে খুন করা হয়েছিলো। সেই খুনের সঙ্গে জড়িত সালমানের স্ত্রী ও তার বাড়ির লোকজন। খুনের সঙ্গে আরও জড়িত রুবির ছোট ভাই ও তার স্বামী। ভিডিও বার্তায় রুবি অনুরোধ করেন সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরীকে, তিনি যেন সালমান খুনের মামলাটি পুনরায় তদন্তের ব্যবস্থা করেন। রুবি নিজে এই খুনের সাক্ষী দেবেন।
কিন্তু আড়াই বছর পূর্বে রুবির দেয়া সেই বক্তব্য তিনি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। এ ব্যাপারে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘রুবি অসুস্থ। অ্যাটর্নি অফিসের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছেন পিবিআই’র কাছে।’
আজিজ মুহাম্মদ ভাইকে নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পিবিআই প্রধান বলেন, ‘যে বাড়িতে সালমান শাহ থাকতো সেখানে অনেকেই যেতো। তবে সেখানে আজিজ মুহাম্মদ ভাই যেত কি না সে ব্যাপারে আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পায়নি। সেখানে সাধারণত যারা সিনেমার সঙ্গে জড়িত তারাই যেত। এর বাইরে আজিজের সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক আমরা পায়নি।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান চিত্রনায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার (ইমন) ওরফে সালমান শাহ। সে সময় এ বিষয়ে অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছিলেন তার বাবা প্রয়াত কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী।
পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান তিনি। অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত।
গত ৩ নভেম্বর ১৯৯৭ সালে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সালমান শাহ’র মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে এটি গৃহীত হয়। সিআইডি’র প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী রিভিশন মামলা দায়ের করেন।
২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত। এরপর প্রায় ১৫ বছর মামলাটি সে তদন্তে ছিল।
২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এ প্রতিবেদনে সালমান শাহ’র মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর এ চিত্রনায়কের মা নীলা চৌধুরী ছেলের মৃত্যুতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান এবং ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেবেন বলে আবেদন করেন।
২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে নারাজির আবেদন দাখিল করেন। সে আবেদনে উল্লেখ করা হয়, আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন তার ছেলে সালমান শাহ’র হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন।
মামলাটি এরপর র্যাব তদন্ত করে। তবে তাদের দ্বারা তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গত বছরের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা করে। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ ৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েস রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশনটি মঞ্জুর করেন এবং র্যাবকে মামলাটি আর না তদন্ত করার আদেশ দেন। তখন থেকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্বে আছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরপরও নানা কারণে দফা দফায় প্রতিবেদন প্রকাশের তারিখ পেছানো হয়। যা সর্বশেষ আজ প্রকাশিত হলো।
৪ বছরে ক্যারিয়ারে মাত্র ২৭টি সিনেমার নায়ক সালমান শাহ। এত কম সংখ্যক সিনেমায় অভিনয় করেও নব্বই দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক হয়ে উঠেছিলেন সালমান শাহ।
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলায় অবস্থিত জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন সালমান। তার পিতা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। পারিবারিক নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন হলেও সিনেমার পর্দায় তিনি ছিলেন শুধুই সালমান শাহ।
ছোট বেলা থেকে অভিনয়ে আগ্রহী সালমান শাহ ১৯৮৫ সালে বিটিভির ‘আকাশ ছোঁয়া’ নাটক দিয়ে অভিনয়ের যাত্রা শুরু করেন। এরপর বেশ কিছু নাটকে অভিনয়ও করেছেন সালমান। নাটকে কাজ শুরু করার ৭ বছর পর, নায়ক আলমগীরের সাবেক স্ত্রী খোশনুর আলমগীরের সন্ধানে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান সালমান শাহ। সহপাঠী মৌসুমীর বিপরীতে অভিনয় করে নিজের প্রথম ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় সাড়া ফেলেন। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সালমান শাহকে, চলচ্চিত্র জীবনে ছুঁয়ে গেছেন জনপ্রিয়তার সবটুকু আকাশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



