আপনার পায়ের নিচে বালি কাঁপছে। সামনে টানা নীল সাগর, পিছনে সবুজে মোড়া পাহাড়ের সারি। কক্সবাজারের এই দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করলেও, একটু গভীরে তাকালে দেখবেন – দূষিত পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে প্লাস্টিক বোতল, বাড়তি পর্যটকের চাপে হাঁসফাঁস করছে স্থানীয় অবকাঠামো, প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষয়ে যাচ্ছে উদ্বেগজনক গতিতে। ভ্রমণ কি শুধুই নিজের আনন্দের জন্য? নাকি সেই আনন্দের ছোঁয়ায় স্থানীয় জনপদ আর প্রকৃতির স্বাস্থ্যকে বাঁচিয়ে রাখাও আমাদের দায়িত্ব? টেকসই পর্যটন শুধু একটি ধারণা নয়, ভবিষ্যতের ভ্রমণের একমাত্র সম্ভাব্য পথ। এটি এমন এক দর্শন, যেখানে আজকের সৌন্দর্য উপভোগের মধ্য দিয়েই আগামী প্রজন্মের জন্য সেই সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রাখার অঙ্গীকার নিহিত। বাংলাদেশ, তার অপরূপ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে, এই টেকসই পথে হাঁটার মাধ্যমে বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।
টেকসই পর্যটন: শুধু ট্রেন্ড নয়, বেঁচে থাকার দর্শন
টেকসই পর্যটন (Sustainable Tourism) বলতে কী বোঝায়? সহজ ভাষায়, এটি এমন এক ধরনের ভ্রমণ পদ্ধতি যা পরিবেশের ওপর ন্যূনতম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিকে সম্মান করে ও তাদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করে, এবং দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার ক্ষমতা বজায় রাখে। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (UNWTO)-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, এটি “পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে টেকসই উন্নয়নের নীতিকে পূর্ণ বিবেচনায় রেখে বর্তমান পর্যটক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে পূর্ণ মনোযোগ প্রদান করে।
- পরিবেশগত দিক: প্রাকৃতিক সম্পদ (পানি, জ্বালানি) সংরক্ষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ভূমিকা রাখা।
- অর্থনৈতিক দিক: স্থানীয় উদ্যোক্তা, কৃষক, কারিগর, গাইড, হোটেল-রেস্তোরাঁ কর্মীদের জন্য ন্যায্য মজুরি ও স্থায়ী আয়ের সুযোগ সৃষ্টি; অর্থ স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রবাহিত রাখা; ঋতুভিত্তিক পর্যটনের চাপ কমিয়ে সারা বছর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
- সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক: স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও জীবনযাপনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া; স্থানীয় সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; শিশুশ্রম ও শোষণ রোধ করা; সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশে টেকসই পর্যটনের তাৎপর্য: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য টেকসই পর্যটন শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়, দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ উন্নয়ন, নারী ক্ষমতায়ন এবং জাতীয় অর্থনীতির বৈচিত্র্য আনয়নের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি আমাদের অতি মূল্যবান সুন্দরবন, পাহাড়ি অঞ্চল, নদী ও উপকূলীয় এলাকাগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার চাবিকাঠি। যেমন, বান্দরবানের রুমা বা থানচিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের অনিয়ন্ত্রিত আগমন স্থানীয় রেশমি, মারমা সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা ও নাজুক পরিবেশকে চাপের মুখে ফেলেছে। টেকসই অনুশীলন ছাড়া এই অঞ্চলগুলোর সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশে টেকসই পর্যটনের বর্তমান চিত্র: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদন (২০২৩) এবং বিশ্বব্যাংকের গবেষণা (২০২২) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
- অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: পর্যটন খাত জিডিপিতে সরাসরি প্রায় ৪% এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ১০% অবদান রাখে। টেকসই মডেলে এই অবদান আরও স্থিতিশীল ও ন্যায্যভাবে বণ্টনযোগ্য।
- পরিবেশগত চাপ: কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন, সাজেক ভ্যালিতে পর্যটক সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে অবকাঠামো (বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি সরবরাহ, শক্তি চাহিদা) ও পরিবেশগত ধারণক্ষমতা সীমিত। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্লাস্টিক দূষণ ও পানি সংকট উদাহরণস্বরূপ।
- স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ: সিলেটের হাকালুকি হাওর বা মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া সংলগ্ন এলাকায় কিছু কমিউনিটি-ভিত্তিক পর্যটন (CBT) উদ্যোগ সফলতা পেয়েছে, যেখানে স্থানীয়রা সরাসরি গাইড, হোমস্টে মালিক, নৌকাচালক বা হস্তশিল্প বিক্রেতা হিসেবে যুক্ত। তবে এই মডেল ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়নি।
- নীতিগত উদ্যোগ: বাংলাদেশ সরকার “জাতীয় ট্যুরিজম পলিসি ২০২২”-এ টেকসই পর্যটন-কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। পরিবেশ বান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, গ্রিন সার্টিফিকেশন চালু, এবং কমিউনিটি ট্যুরিজমকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। পর্যটন বোর্ড কিছু এলাকায় “ক্যারিং ফর ডেস্টিনেশন” কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তবে বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ে ঘাটতি রয়েছে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে: রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার এলাকার একটি ছোট হোমস্টে মালিক, শ্রীমতি ঝর্ণা ত্রিপুরা (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “আগে বড় বড় হোটেলগুলো সব আয় নিয়ে যেত। এখন আমাদের কমিউনিটি হোমস্টে গড়ে উঠেছে। পর্যটকরা আমাদের সংস্কৃতি শেখে, স্থানীয় খাবার খায়, হস্তশিল্প কেনে। আমাদের আয় বেড়েছে, আর আমরা নিজেরাই জঙ্গল পরিষ্কার, পানি সাশ্রয়ের দিকে নজর দিই। এটাই তো টেকসই পর্যটন।”
টেকসই পর্যটনের সুবিধা: কেন এটি অপরিহার্য?
টেকসই পর্যটন শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়; এর সুদূরপ্রসারী সুবিধা রয়েছে সকলের জন্য:
- দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: স্থানীয় অর্থনীতিতে টাকা আটকে রাখে। কমিউনিটি-ভিত্তিক পর্যটন স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, বিশেষ করে নারী ও যুবকদের জন্য। ঋতুভিত্তিকতার ওপর নির্ভরতা কমে, সারা বছর আয়ের প্রবাহ নিশ্চিত হয়। উদাহরণ: বরিশালের ঐতিহ্যবাহী নৌকা (যেমন গোয়ালিনী নৌকা) দিয়ে পর্যটক ভ্রমণের ব্যবস্থা করে স্থানীয় নৌকার মাঝিদের আয় বৃদ্ধি।
- প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ: যখন পর্যটন আয়ের উৎস হয়, তখন স্থানীয় সম্প্রদায় তাদের পরিবেশ ও সংস্কৃতি রক্ষায় আগ্রহী হয়। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ রক্ষা, বান্দরবানের আদিবাসী তাঁত শিল্পের পুনরুজ্জীবন, বা ঢাকার পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচার – সবই টেকসই পর্যটন-এর মাধ্যমে জোরদার হয়।
- উন্নত পর্যটক অভিজ্ঞতা: টেকসই পর্যটন প্রায়শই ছোট গোষ্ঠীতে ভ্রমণ, স্থানীয় গাইডের সহায়তা, এবং কমার্শিয়াল হটস্পটের বাইরে অথেনটিক অভিজ্ঞতার সুযোগ দেয়। এর ফলে পর্যটকরা গভীরভাবে সংযুক্ত হন, সত্যিকারের স্মৃতি সংগ্রহ করেন এবং গন্তব্যের প্রতি সম্মানবোধ গড়ে তোলেন।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক: পরিবেশ-বান্ধব রিসোর্ট (সৌরশক্তি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ), ইলেকট্রিক বা সাইকেল ভ্রমণ, স্থানীয় ও জৈব খাদ্য পছন্দ – এই সবই কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমায়। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
- সামাজিক সাম্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি: সাংস্কৃতিক বিনিময়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই পর্যটন সামাজিক সংহতিকে শক্তিশালী করতে পারে। এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে।
টেকসই পর্যটন চর্চার বাস্তব উদাহরণ: বাংলাদেশে ও বিশ্বে
বাংলাদেশের উদাহরণ:
- সুন্দরবনের জন্য দায়িত্বশীল ভ্রমণ: কিছু ট্যুর অপারেটর (যেমন Tour de Sundarbans, Discover Bangladesh) এখন ছোট নৌকা ব্যবহার করে, নির্দিষ্ট ট্রেইল মেনে চলে, প্লাস্টিকমুক্ত ভ্রমণ নিশ্চিত করে, স্থানীয় বন সংরক্ষণ কর্মীদের সাথে কাজ করে এবং পর্যটকদের ম্যানগ্রোভ রোপণে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়। তারা UNWTO-র গ্লোবাল ট্যুরিজম প্লাস্টিক ইনিশিয়েটিভে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের সুন্দরবন গাইডলাইনস অনুসরণকে উৎসাহিত করে।
- সাজেক ভ্যালিতে কমিউনিটি হোমস্টে: স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায় পরিচালিত হোমস্টেগুলো (যেমন Runmoy Homestay, Konglak Para Homestay) পর্যটকদের আদিবাসী জীবনযাপন, খাদ্য ও সংস্কৃতি সরাসরি উপলব্ধি করার সুযোগ দেয়। আয়ের একটি বড় অংশ স্থানীয় কমিউনিটি তহবিলে যায়, যা স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। পর্যটক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়রা সচেতন।
- বার্ড স্যাংচুয়ারি ট্যুর, টাঙ্গুয়ার হাওর: টাঙ্গুয়ার হাওরে স্থানীয় নৌকার মাঝিদের দ্বারা পরিচালিত পাখি পর্যবেক্ষণ ট্যুর স্থানীয় অর্থনীতিকে সমর্থন করে এবং জলাভূমির জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে পর্যটক ও স্থানীয় উভয়কেই সচেতন করে। আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রকল্প এই ধরনের উদ্যোগকে সমর্থন করে।
- ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প কেন্দ্র: নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, জামদানি শাড়ি, মৃৎশিল্পের কেন্দ্রগুলিতে (যেমন জামালপুরের নকশিকাঁথা গ্রাম, নরসিংদীর পলিবাড়ী মৃৎশিল্প গ্রাম) সরাসরি কারিগরদের কাছ থেকে কেনা পর্যটকদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে টেকসই এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা।
বিশ্বের অনুপ্রেরণাদায়ক উদাহরণ:
- ভুটান: “হাই ভ্যালু, লো ইমপ্যাক্ট” মডেল। প্রতিদিনের উচ্চ মানের খরচের একটি অংশ পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ করা হয়। পর্যটক সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
- কোস্টা রিকা: জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকোট্যুরিজমে বিশ্বনেতা। বিপুল সংখ্যক হোটেল কাস্টা রিকা ট্যুরিজম বোর্ডের (ICT) ‘কাস্টা রিকা সাসটেইনেবল ট্যুরিজম’ (CST) সার্টিফিকেশন পেয়েছে, যা পরিবেশ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ড যাচাই করে।
- কেনিয়া: অনেক বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য স্থানীয় মাসাই সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন বা যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়, যাতে পর্যটন আয় সরাসরি সংরক্ষণ ও সম্প্রদায় উন্নয়নে যায়।
টেকসই পর্যটনের চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন-এর পথ মসৃণ নয়:
- সচেতনতার অভাব: অনেক পর্যটক, স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং এমনকি কিছু নীতিনির্ধারকও টেকসই পর্যটনের সুবিধা ও জরুরিতা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নন।
- অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (বিশেষ করে প্লাস্টিক), পানি শোধন, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার, এবং পরিবেশ-বান্ধব পরিবহন (ইলেকট্রিক বাস/নৌকা) ব্যবস্থার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
- অর্থায়নের ঘাটতি: পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি (সোলার প্যানেল, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, ওয়েস্ট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট) এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে উচ্চ বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা ছোট উদ্যোক্তাদের পক্ষে করা কঠিন।
- দুর্নীতি ও দুর্বল শাসন: কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন থাকলেও বাস্তবায়ন ও মনিটরিং দুর্বল। পরিবেশগত নিয়ম লঙ্ঘনের শাস্তি প্রায়শই প্রয়োগ হয় না।
- কমিউনিটি ক্ষমতায়নের অভাব: অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রকৃত অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সীমিত থাকে। লাভের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
- অত্যধিক পর্যটন (Overtourism): কক্সবাজার বা সেন্ট মার্টিনের মতো জনপ্রিয় গন্তব্যে বিশেষ দিন বা ঋতুতে পর্যটকের চাপ ধারণক্ষমতার অনেক উপরে চলে যায়, যা পরিবেশ ও স্থানীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করে।
ভবিষ্যতের পথ: কিভাবে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ?
টেকসই পর্যটন-কে বাংলাদেশের ভ্রমণ খাতের মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন:
সরকারের ভূমিকা:
- জাতীয় টেকসই পর্যটন কৌশলপত্র: বর্তমান নীতির কঠোর বাস্তবায়ন এবং একটি সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন।
- আইন ও নীতিমালা শক্তিশালীকরণ: পরিবেশগত মান (বর্জ্য নিষ্কাশন, শব্দদূষণ, নির্মাণ নিয়ম), ক্যারিয়িং ক্যাপাসিটি নির্ধারণ এবং তার কঠোর প্রয়োগ। ভঙ্গকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি।
- অর্থনৈতিক প্রণোদনা: পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি (সৌর, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জৈবগ্যাস) ও টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে ঋণ সুবিধা, ভর্তুকি ও কর রেয়াত।
- গ্রিন সার্টিফিকেশন চালু: বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক মানদণ্ড নিয়ে একটি জাতীয় টেকসই পর্যটন সার্টিফিকেশন সিস্টেম চালু করা (যেমন কোস্টারিকার CST মডেল অনুসরণে)।
- কমিউনিটি-ভিত্তিক পর্যটন (CBT) এর প্রসার: CBT উদ্যোগগুলিকে প্রশিক্ষণ, বিপণন সহায়তা এবং তহবিল সুবিধা প্রদান।
- গবেষণা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা: টেকসই পর্যটনের প্রভাব (পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক) নিয়মিত মূল্যায়ন এবং তথ্য ভান্ডার গড়ে তোলা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এর সাথে সমন্বয়।
শিল্পের ভূমিকা (ট্যুর অপারেটর, হোটেল, রেস্তোরাঁ):
- টেকসই অনুশীলন গ্রহণ: শক্তি ও পানি সাশ্রয়, বর্জ্য কমানো ও পুনর্ব্যবহার (জিরো-ওয়েস্ট লক্ষ্য), স্থানীয় ও জৈব খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার, প্লাস্টিক মুক্ত অপারেশন।
- স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার: স্থানীয় পণ্য, পরিষেবা ও কর্মী নিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
- পর্যটক শিক্ষা: দায়িত্বশীল আচরণ (জলাশয়ে সাবান/শ্যাম্পু না ব্যবহার, প্লাস্টিক না ফেলা, সংস্কৃতিকে সম্মান করা) সম্পর্কে পর্যটকদের শিক্ষিত করা।
- কমিউনিটির সাথে অংশীদারিত্ব: স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অংশ নেওয়া এবং আয়ের একটি অংশ ফেরত দেওয়া।
- গ্রিন সার্টিফিকেশন অর্জন: আন্তর্জাতিক মান (যেমন EarthCheck, Green Key) বা ভবিষ্যতের জাতীয় মান অনুসরণ করা।
পর্যটকদের ভূমিকা (আমাদের সবার ভূমিকা):
- সচেতন পছন্দ: যেসব ট্যুর অপারেটর ও থাকার জায়গা টেকসই পর্যটন চর্চা করে তাদের বেছে নেওয়া। সার্টিফিকেশন বা তাদের পরিবেশ/সম্প্রদায় নীতিগুলো খোঁজা।
- দায়িত্বশীল আচরণ:
- পানি ও বিদ্যুৎ সর্বোচ্চ সাশ্রয় করুন।
- রিইউজেবল বোতল/ব্যাগ ব্যবহার করুন; প্লাস্টিক বর্জ্য সর্বনিম্ন করুন।
- নির্দিষ্ট ট্রেইল ও পথ মেনে চলুন; বন্যপ্রাণীকে খাওয়াবেন না বা বিরক্ত করবেন না।
- স্থানীয় সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও পোশাকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন (যেমন পাহাড়ি এলাকায় পোশাকের ব্যাপারে সংবেদনশীল হওয়া)।
- স্থানীয় হস্তশিল্প ও পণ্য কিনুন; দর কষাকষি করুন, কিন্তু ন্যায্য মূল্য দিন।
- স্থানীয় খাবার উপভোগ করুন (খাদ্যের মাইলেজ কমায়)।
- হোমস্টে বা স্থানীয় পরিবার পরিচালিত গেস্ট হাউসে থাকার চেষ্টা করুন।
- শিখুন ও সম্মান করুন: গন্তব্যের ইতিহাস, সংস্কৃতি, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং কিছু মৌলিক স্থানীয় শব্দ শিখুন। এটি গভীর সংযোগ তৈরি করে।
- স্থানীয় সম্প্রদায়ের ভূমিকা:
- সক্রিয় অংশগ্রহণ: পর্যটন পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া।
- সংস্কৃতি ও পরিবেশ রক্ষা: নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা।
- নিরাপত্তা ও আতিথেয়তা: পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও আতিথেয়তাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
- ন্যায্য মূল্য নীতি: পণ্য ও পরিষেবার জন্য ন্যায্য ও স্বচ্ছ মূল্য নির্ধারণ করা।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. টেকসই পর্যটন আসলে কী, এবং এটি সাধারণ পর্যটন থেকে কেমন আলাদা?
টেকসই পর্যটন এমন এক ভ্রমণ পদ্ধতি যা পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে, স্থানীয় সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করে এবং তাদের সংস্কৃতিকে সম্মান করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও গন্তব্যের সৌন্দর্য ও সম্পদ টিকিয়ে রাখে। সাধারণ পর্যটন প্রায়শই পরিবেশের ওপর বেশি চাপ ফেলে (অত্যধিক বর্জ্য, সম্পদ ব্যবহার), স্থানীয় অর্থনীতিতে কম অবদান রাখে (বহুজাতিক কোম্পানির লাভ বেশি যায়), এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে বিকৃত করতে পারে বা শোষণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। টেকসই পর্যটন দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে।
২. বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন অনুশীলনের কিছু সহজ উপায় কি কি?
হ্যাঁ, কিছু সহজ পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে: প্লাস্টিকের বোতলের বদলে রিইউজেবল বোতল ব্যবহার, হোটেল/রেস্টুরেন্টে পানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা, স্থানীয় বাজারে গিয়ে স্থানীয় হস্তশিল্প ও পণ্য কেনা, স্থানীয় খাবার খাওয়া, স্থানীয় গাইড বা হোমস্টে বেছে নেওয়া, নির্দিষ্ট পথে/ট্রেইলে হাঁটা এবং বন্য প্রাণীকে না খাওয়ানো বা বিরক্ত না করা। ছোট ছোট এই অভ্যাসগুলোই বড় পরিবর্তন আনে।
৩. টেকসই পর্যটন কি শুধু বন্যপ্রাণী বা গ্রামীণ এলাকার জন্য প্রযোজ্য? শহুরে পর্যটনে কি এর ভূমিকা আছে?
একদমই আছে! ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো শহরেও টেকসই পর্যটন চর্চা করা যায়। ঐতিহ্যবাহী রিকশায় চড়া (কার্বন নিঃসরণ কম), স্থানীয় পরিবহন (বাস, মেট্রো রেল) ব্যবহার, কমিউনিটি ট্যুরে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার বা কারুশিল্প দেখার জন্য যাওয়া, স্থানীয় শিল্পীদের দোকান থেকে নকশিকাঁথা বা শীতলপাটি কেনা, এমনকি পানি বোতল পুনঃব্যবহার করা – সবই টেকসই পর্যটনের অংশ। শহুরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সবুজ স্থান সংরক্ষণে পর্যটকদের ভূমিকা থাকে।
৪. টেকসই পর্যটন কি বেশি খরচের? আমি কি সাধারন বাজেটে দায়িত্বশীল ভ্রমণ করতে পারি?
অগত্যা নয়। হোমস্টে বা গেস্ট হাউসে থাকা প্রায়শই বড় হোটেলের চেয়ে সস্তা এবং স্থানীয়দের কাছে সরাসরি অর্থ পৌঁছায়। স্থানীয় পরিবহন (বাস, ট্রেন, রিকশা) ব্যবহারও সাশ্রয়ী। স্থানীয় বাজারে খাওয়া বা রান্না করা পর্যটকী এলাকার রেস্তোরাঁর চেয়ে কম খরচে হয়। মূল বিষয় হল সচেতন পছন্দ: বিলাসবহুল রিসোর্টের বদলে কমিউনিটি-ভিত্তিক থাকা, দামি স্যুভেনিরের বদলে স্থানীয় কারুশিল্প কেনা। আপনার বাজেটেই আপনি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
৫. টেকসই পর্যটনের জন্য বাংলাদেশে কোন কোন জায়গা ভালো উদাহরণ?
বাংলাদেশে বেশ কিছু উদীয়মান উদাহরণ রয়েছে: সাজেক ভ্যালির স্থানীয় আদিবাসী পরিচালিত হোমস্টে (কংলাক, রুনময়), সুন্দরবনে পরিবেশ-সচেতন ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে দায়িত্বশীল নৌকা ভ্রমণ, টাঙ্গুয়ার হাওরে স্থানীয় নৌকাচালকদের পাখি পর্যবেক্ষণ ট্যুর, সিলেটের চা বাগানে কিছু ইকো-ফ্রেন্ডলি রিসোর্ট, বরিশাল অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী নৌকায় ভ্রমণ। এছাড়া লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আশেপাশে কমিউনিটি ট্যুরিজমের প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
৬. আমি একজন পর্যটক হিসেবে কিভাবে জানব যে কোন ট্যুর অপারেটর বা হোটেল সত্যিকার অর্থে টেকসই অনুশীলন করে?
এটি একটি চ্যালেঞ্জ, তবে কিছু সূত্র অনুসরণ করতে পারেন: তাদের ওয়েবসাইটে পরিবেশ ও সামাজিক নীতির (Environmental & Social Policy/ CSR Policy) উল্লেখ আছে কিনা দেখুন। তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে কীভাবে কাজ করে (যেমন কমিউনিটি ফান্ডে অবদান, স্থানীয় নিয়োগ) তা জিজ্ঞাসা করুন। তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি সাশ্রয়, শক্তি ব্যবহার (সৌর) সম্পর্কে কী বলে তা খতিয়ে দেখুন। আন্তর্জাতিক বা (ভবিষ্যতের) জাতীয় গ্রিন সার্টিফিকেশন আছে কিনা চেক করুন। অনলাইন রিভিউতে অন্য পর্যটকরা স্থানীয় সম্পৃক্ততা বা পরিবেশ সচেতনতার কথা উল্লেখ করেছেন কিনা দেখুন। সরাসরি তাদের সাথে কথা বলে তাদের অভ্যাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন – প্রকৃত টেকসই প্রতিষ্ঠানগুলি এ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে।
টেকসই পর্যটন শুধু একটি ভ্রমণ পদ্ধতি নয়; ভবিষ্যতের পৃথিবী ও বাংলাদেশের জন্য বেঁচে থাকার দর্শন। আমাদের প্রিয় কক্সবাজারের সৈকত, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, পাহাড়ি জনপদের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র পথ হল দায়িত্বশীল ভ্রমণকে অভ্যাসে পরিণত করা। সরকার, শিল্প, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং প্রতিটি পর্যটকের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, যেখানে আনন্দের সাথে সংরক্ষণ হাত ধরাধরি করে চলে। ভবিষ্যতের ভ্রমণ এরই নাম টেকসই পর্যটন। আপনার পরবর্তী ভ্রমণের পরিকল্পনা করার সময় শুধু জায়গাটিই নয়, ভাবুন আপনি কীভাবে সেই জায়গা ও সেখানকার মানুষদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন। একটি প্লাস্টিকের বোতল কম, একটি স্থানীয় শিল্পকর্ম বেশি কেনা, এক কদম পা হেঁটে দেখার মধ্যে দিয়েই শুরু হোক আমাদের সবার জন্য একটি উজ্জ্বল, সবুজ ভবিষ্যতের পথচলা। আজই সিদ্ধান্ত নিন, ভ্রমণ করুন দায়িত্বের সাথে, গড়ে তুলুন টেকসই আগামী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।