করোনার ভুয়া সনদ দিয়ে আলোচনায় আসা রিজেন্ট গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ সহায়-সম্পদ ও নিজেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে অভিযান ঠেকাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের কাছে ফোন করে র্যাবের বিরুদ্ধে নালিশও করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা, গণমাধ্যমের কিছু নেতা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককেও ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো তদবিরই কাজে আসেনি। উল্টো ফেঁসেই গেছেন তিনি। সাহেদের ফোনের কললিস্টে থাকা ‘রথী-মহারথীদের’ মোবাইল নাম্বার উদ্ঘাটন করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। অভিযানের আগে ও পরে ওইসব প্রভাবশালীর সঙ্গে তার কথাবার্তার তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে তার তোলা ছবি ভাসছে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে পলাতক সাহেদকে গ্রেপ্তার করতে র্যাবসহ একাধিক সংস্থা কাজ করছে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল জানিয়েছেন, সাহেদ দেশের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছেন।
সাহেদের অন্যতম সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এদিকে সাহেদ অপরাধ করলে বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তার স্ত্রী সাদিয়া আরবি রিম্মি।
সংশ্লিষ্টরা স জানান, চলতি মাসের প্রথম দিকেই সাহেদ আঁচ করতে পেরেছিলেন তার সামনে বড় বিপদ। তারপর থেকে তিনি ‘বড় বড় জায়গায়’ যোগাযোগ করে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেন। পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, সাহেদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি অনেক রথী-মহারথীর সঙ্গে কথা বলেছেন। এমন এমন লোকের সঙ্গেও কথা বলেছেন তাদের নাম বলা যাচ্ছে না। দেশের অনেক ভিআইপি ও সিআইপির মোবাইল নাম্বার আছে তার মোবাইলে। তিনি ঠা-া মাথার প্রতারক। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানম-ি এলাকায় বিডিএস ক্লিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে একশ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেন। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে গা-ঢাকা দিলে গ্রাহকরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। তারপরই রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। রিজেন্ট এয়ার কিন্তু এই প্রতারকের নয়।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে সাহেদ প্রতারণা করতেন। সরকারি দপ্তরগুলোতে সাহেদ নিজেকে কখনো সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্তÑএমন নানা পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। পুলিশের ইউনিটগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ‘স্পন্সর হয়ে’ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। তিনি বলেন, ‘সাহেদ কিছু ফেইক ছবি তৈরি করেছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। অপকর্মগুলো করতেই ওইসব ছবি কাজে লাগাতেন সাহেদ। এখন তার পরিবারের সদস্যরাই সাহেদের বিরুদ্ধে চলে গেছেন। তার কঠিন শাস্তি দাবি করেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আমাদের সহায়তা করছেন।’
ফোন করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে : পলাতক সাহেদ দেশের ভেতরে আছেন এবং তাকে খুব শিগগির গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল ধানম-ির নিজ বাসায় সাংবাদিকদের সামনে তার সম্পর্কে তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তিনি নিজে একজন রোগীকে ভর্তি করার জন্য কদিন আগে সাহেদকে ফোন করেছিলেন। সে সুবাদে সাহেদ ঘটনার দিন ৭ জুলাই তাকে ফোন করে র্যাবের অভিযান সম্পর্কে নালিশ করেন এবং সিলগালার কথা জানান। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই কোনো অন্যায় কাজ করেছেন, এজন্য সিল করছে। বিনা কারণে তো সিল করে না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তখন সে বলল আমি তাহলে কী করব? আমি বললাম, হয় আপনি ফেইস করেন, নতুবা আপনার যদি কিছু বলার থাকে কোর্টে যান। এইটুকুই আমি বলেছি।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘যত বড় ক্ষমতাবানই হোক না কেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে সাহেদকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রধানমন্ত্রী তার সংসদ সদস্যকে ছাড় দেননি, তার দলীয় নেতাদেরও ছাড় দিচ্ছেন না। যার কথা বলেছেন তাকে ধরার জন্য অনুসন্ধান চলছে।’
যেকোনো সময় গ্রেপ্তার : গতকাল বিকেলে র্যাবের মুখপাত্র ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আসিক বিল্লাহ গতকাল বলেন, ‘সাহেদকে ধরতে র্যাবের পেশাদারিত্ব এবং দায়িত্ববোধের চাপ আছে। সেই চাপ থেকেই আমরা তাকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে র্যাবের বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় র্যাবের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তিনি যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হবেন।’ করোনায় মৃত বাবার জানাজায় সাহেদ উপস্থিত হতে পারেন, এমন সম্ভাবনা থেকে সেখানে নজরদারি রাখা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেননি।
সাহেদের সহযোগী তারেক রিমান্ডে : সাহেদের অন্যতম সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল ৫ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। গত বৃহস্পতিবার নাখালপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গতকাল তাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়েছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক আলমগীর গাজী। শুনানি শেষে বিচারক ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সীমান্ত ও ইমিগ্রেশনে সতর্ক পুলিশ ও বিজিবি : সাহেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞায় সতর্ক অবস্থায় রয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ ও বিজিবি কর্র্তৃপক্ষ। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, যোগাযোগব্যবস্থা সহজ ও বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এপথে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এজন্য দেশের অন্যান্য সীমান্তের পাশাপাশি এ সীমান্তের ইমিগ্রেশন পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীরা সতর্কতা অবলম্বন করেছে। ৪৯ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল সেলিম রেজা জানান, এমনিতেই তারা সব ধরনের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে সতর্ক থেকে কাজ করছেন। আর এ ধরনের পরিস্থিতির খবর পেয়ে সীমান্তে দায়িত্বরতদের আরও সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। বেনাপোল ইমিগ্রেশনের (ওসি) আহসান হাবিব জানান, সাহেদের দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করে বেনাপোল ইমিগ্রেশনে একটি বার্তা এসেছে। কোনো কৌশল অবলম্বন করে যেন তিনি ভারতে পালাতে না পারেন সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
বিচার চান স্ত্রীও : সাহেদ অপরাধ করলে বিচার হওয়া উচিত বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তার স্ত্রী সাদিয়া আরবি রিম্মি। তিনি বলছেন, র্যাবের অভিযানের পর ৭ জুলাই দুপুরে সর্বশেষ মোবাইল ফোনে সাহেদের সঙ্গে কথা হয় তার। সাহেদ নিরাপদে আছে বলে তাকে জানিয়েছেন। এরপর থেকে সাহেদের মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাচ্ছেন তিনি। রিম্মি জানান, তার ধারণা ছিল ২০০৮ সালে এমএলএম ব্যবসার ঘটনায় জেল খেটে সাহেদ শুধরে গেছেন। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর ওল্ড ডিওএইচএস ৪ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন সাহেদ। ৬ জুলাই বিকেলে সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর তিনি আর বাসায় যাননি বলে জানিয়েছেন স্ত্রী রিম্মি। তবে দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়িতেই রয়েছেন সাহেদের স্ত্রী। রিম্মি বলেন, ‘এত কিছু আমি কখনই টের পাইনি। কীভাবে ঘটল এত সব! আমরা পুরো পরিবার শকড। সাহেদ কোনো অপরাধ করলে তার বিচার হওয়া উচিত। সবাই যেমন তার বিচার চাচ্ছে, আমিও তার বিচার চাই।’ সাহেদ কেবল মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন এমন কিছু জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই কথা সত্য না। তিনি ভারতের পুনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিল্ম স্টাডিজ বিষয়ে লেখাপড়া করেন। এরপর দেশে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন, তবে সেটা শেষ করতে পারেননি। আর আমি তো সার্টিফিকেট দেখে বিয়ে করিনি।’
করোনায় সাহেদের বাবার মৃত্যু : স্বজনরা জানিয়েছেন, পরিবারের ধারণা ছিল সাহেদ হয়তো আত্মসমপর্ণ করে শেষবারের মতো বাবা সিরাজুল ইসলামের মরদেহ দেখতে আসতে পারেন। সেজন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর সাহেদের বাবাকে আজিমপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিরাজুল ইসলাম মারা যান। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী জানান, সিরাজুল ইসলাম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি তাদের হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য জটিলতা ছিল। সূত্র: দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।