আন্তর্জাতিক ডেস্ক : একটি দুর্ঘটনা পাকিস্তানের লাহোরের বাসিন্দা দাউদের জীবনটা বদলে দেয়, শুধু বদলায় না সানা আর দাউদের প্রেমের সম্পর্ক। চিকিৎসকরা প্রথম দাউদের হাতের অর্ধেকটা কাটেন, পরে পুরোটা কেটে ফেলেন। বদলে যায় তার চিরচেনা পৃথিবী, শুধু বদলায় না সানা আর দাউদের প্রেমের সম্পর্ক। যে সামাজিক বাধা আর চাপ উপেক্ষা করে দাউদের জীবনসঙ্গী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সানা, তা করা অন্য যে কারো পক্ষেই খুবই কঠিন হতো।
সানা এবং দাউদের মধ্যে আগেই পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তাদের পরিচয় অনেক দিনের। তারা এক সময় স্বপ্ন দেখতেন তা এখন সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। এর মধ্যে সানার পরিবার তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি রাজি হন না। এক পর্যায়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এক খালার বাসায় তিনি এক মাস থাকেন। পরে দাউদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরিবারের সহায়তায় বিয়ে করে।
সানা বলেন, ‘আমার পরিবার একেবারেই মেনে নেয়নি। তারা বলেছিল দাউদের হাত নেই, পা নেই। কিন্তু আমি বলেছিলাম তাকে আমি একা ছাড়তে পারবো না। এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে অনেক ঝগড়াও হয়েছিল। আমি বলেছিলাম দাউদের সাথেই থাকতে চাই। তারা বলেছিল, শুধু একজন মানুষের জন্য বাকি সবাইকে ত্যাগ করবে? আমি বলেছিলাম আমার আরও দরকার নেই।
দাউদ সিদ্দিকী সম্প্রতি এক দুর্ঘটনার শিকার হন। বাড়িতে কাজ করার সময় তিনি প্রচণ্ড ইলেকট্রিক শক পান। এতে প্রাণে বেঁচে গেলেও দাউদের দুটি হাত ও একটি পা নষ্ট হয়ে যায়। চিকিৎসক জানায়, দাউদের দুটো হাত জোড়া লাগানো যাবে। কিন্তু সেটা হবে অসাড়। প্রথমে তারা কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলে, পরে পুরো হাত দুটোই কেটে ফেলতে হয়।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সানা ছুটে যায় হাসপাতালে। সানা জানান, অপারেশন থিয়েটার থেকে তাকে ৮ ঘণ্টা পর বের করা হয় দাউদকে। আমি তার কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলতেই সে চোখ খোলে। বললাম, ভয় পেও না আমি তোমার সাথেই আছি। কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাব না।
দাউদ বলেন, ভাবলাম আমি যদি আমার সঙ্গে তাকে থাকতে বলি, তাহলে হয়তো সে করবে। কিন্তু আমার দিক থেকে কোনো চাপ এলে তার পুরো জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই ব্যাপারটি আমি তার ওপরে ছেড়ে দিলাম।
সানা বলেন, তখন আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, তাকে যখন আমি কথা দিয়েছি সেই কথা আমি রাখবো। আমি অন্য কোনো কিছু ভাবতে পারছিলাম না। শুধু দাউদের কথাই ভাবছিলাম।
সানা দাউদকে অভয় দিয়ে বলেন, আমি তো আছি। খোদা যদি তোমার হাত দুটো নিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি তোমার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন।
দাউদের মনে শুরু হয় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঝড়। সানাকে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিতে দাউদের খুব কষ্ট হচ্ছিল। তিনি আবার চেষ্টা করলেন সানার মত বদলানোর জন্য।
দাউদ জানায়, কিছুটা খুশি তো হয়েই ছিলাম, কিন্তু সে যখন জানাল যে তার পরিবার কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। তখন আমি তাকে বললাম, তোমার পরিবার ঠিক কথাই বলছে। কোনো বাবা-মা তাদের সন্তানদের খারাপ চায় না।
চিকিৎসকরা প্রতিদিনই বলতো দাউদ আর বাঁচবে না। তারা বলতো, সে আজ বা কাল মারা যাবে।
সানা জানায়, এসব দেখে পরিবারের সবাই বোঝানোর চেষ্টা করে বলে, দ্যাখো বেটি দাউদ আর বাঁচবে কিনা জানি না। সবকিছুই আমি উপেক্ষা করেছি, শুধু বলেছি আমি দাউদের সাথে থাকতে চাই।
সানা আরও বলেন, আমাদের সম্পর্কের এক বছর পার হয়েছে। আমরা শুরুতে ফোনে কথা বলতাম, ঘুরতে যেতাম। ধীরে ধীরে টের পেলাম আমাদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়েছে। একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচবো না। সে আমাকে খুবই ভালোবাসে, আমিও তাই।
দাউদ বলেন, আমরা জীবন-মরণে একসাথে থাকার কছম খেয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমার অবস্থা এমন ছিল না। সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলাম। এখন যখন কেউ আমাকে ওয়াশরুমে যেতে সাহায্য করে, তখন মনটা একদম ভেঙে যায়। তবে সানা আমার মন ভালো করার জন্যে অনেক চেষ্টা করে। আমি কখনোই ভাবিনি আমার জীবনে এমনটা ঘটবে।
সানা বলেন, আমার মনে আছে আমরা একসাথে কি কি করবো, তা নিয়ে কত কথা বলতাম। এখনো যখন আমি ভাই বা মামার সাথে বাইরে যাই, সে তখন বলে অন্য কারও সাথে তার যেতে হচ্ছে দেখে তার খুব দুঃখ হয়। আমি তাকে বলি, এটা নিয়ে তুমি কিচ্ছু ভেব না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমার সাথেই আবার বাইরে যাব। আমি তাকে কখনোই মন খারাপ হতে দেই না। সব সময় তার পাশে হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করি। আমার মন খারাপ হলেও তাকে বুঝতে দেই না।
সানা আরও বলেন, আমি দাউদের কাছে আসি। তার পরিবার আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে, তারপর থেকেই আমরা একসঙ্গে আছি।
এখন সানা সব কিছুতেই দাউদকে সাহায্য করেন। তারা খুব সুখী। কিন্তু একটা বিষয়ে তাদের মনে খুব দুঃখ। সানার পরিবার তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।
সানা বলেন, একদিন বাবা ফোনে কল করেছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলাম। বাবাও আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেন। কিন্তু যখন আমি বললাম বাবা তুমি দাউদের সঙ্গে একটু কথা বলো, তখন তিনি ফোন কেটে দেন। আমি দাউদকে বোঝালাম এক সময় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে।
সানা বলেন, আমি ভাবি এই ঘটনা যদি আমার সাথে ঘটতো, তাহলে আমার বাবা-মা কী করতেন? তখন যদি দাউদ বলতো, আমি সানাকে বিয়ে করবো, তাহলে তারা কত খুশি হতেন। আমি দাউদের সঙ্গে ভালো আছি, তারপরও তারা কেন খুশি হতে পারেন না? তাদের মেয়ে যে একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এইজন্যে তাদের খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু তারা সেটা মানতে রাজি না।
তবে দাউদ ভেঙে পড়েননি। জীবনকে সুন্দর করার জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দাউদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রতঙ্গ এর জন্য আবেদন জানান। কিম্বা ছেটোখাটো কোনো ব্যবসার ব্যবস্থা করে দেন।
দাউদ বলেন, সানা আমার জন্য যেটা করেছে, কারণ তার হৃদয় অনেক বড়। এটা অনেকেই পারে না। সে আমার জন্য সবকিছু ছেড়েছে। আমার আশা সানার পরিবার আবার তার সাথে দেখা করবে।
সানা চায় দাউদ ভালো হোক। তার হাত এবং পা ফিরে পাক। সানা যেন দেখতে পায়, দাউদ যেন তার চারপাশে চলাফেরা করছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।