সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক পতনের কারণ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ব্যাংক অবসায়ন করা হয়েছে– সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক। অনেকেই বোঝার চেষ্টা করছেন বিষয়টা। ভাবছেন, আমাদের এখানেও কি ব্যাংকের অবস্থা এমন হতে পারে? বিষয়টা বুঝতে হলে আপনাকে আগে বন্ড মার্কেট বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট কী? সেই সঙ্গে যদি আমেরিকার আঙ্গিকে আমাদের দেশে বিপর্যয় ঘটবে কিনা– বুঝতে চান, তাহলে আপনাকে দুই দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
বন্ড হচ্ছে এমন একটা ফাইন্যান্সিয়াল ডেট (ঋণ) ইনস্ট্রুমেন্ট, যেটিতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা হয় এবং মুনাফার হার ফিক্সড থাকে। সাধারণত মার্কিন বন্ডগুলো ২০-৩০ বছর মেয়াদি হয়। এই মার্কেটের সুবিধা হচ্ছে আপনি একটা নির্দিষ্ট মুনাফা ফিক্সড করে ফেলছেন। অনেকটা ব্যক্তি খাতে মানুষ যেভাবে সঞ্চয়পত্র কিনে নিরাপদ থাকতে চায়, তেমন। এই দুটো ব্যাংক (সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক) বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছিল বন্ড মার্কেটে। ঝামেলাটা হয়েছে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোয়। এর ফলে ওই দুই ব্যাংক বন্ডে আগে বিনিয়োগকৃত অর্থের জন্য বাড়তি মুনাফা পাবে না। আবার মেয়াদপূর্তির আগে বন্ড ভাঙালেও অনেক কম মুনাফা পাবে। বন্ড ভাঙালেও বিপদ, রাখলেও বিপদ। রাখলে কী বিপদ? বন্ড রেট নির্ধারিত হয় চলমান ব্যাংক সুদের হার অনুসারে। অর্থাৎ বন্ড রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজারে ব্যাংকের মুনাফা রেট নির্ধারণ হয়। ইউএস বাজারে মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে শুধু বন্ড মার্কেটই নয়, ব্যাংকিং সেক্টরেও সুদের হার বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোকে আগের চেয়ে বেশি মুনাফা/সুদ গ্রাহককে দিতে হচ্ছে বা হবে। এদিকে এই দুই ব্যাংক আটকে গেছে আগের বন্ড রেটে। ফলে কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাচ্ছিল ব্যাংকগুলোর।
এর সঙ্গে উল্লেখ করা যায় বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের রিপোর্ট অনুসারে করোনা মহামারি শুরুর পর ব্যবসা- বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়লে টেকনোলজি বেজড ( যেখানে বাইরে কাজের চেয়ে ইনডোর কাজের সুযোগ বেশি) কোম্পানিগুলো ভালো করতে থাকে। ফলে মানুষ তার কাছে থাকা অলস টাকা প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বেশি এমন ব্যাংকে আমানত হিসেবে গচ্ছিত রাখা বাড়িয়ে দেয়। ফোর্বস-এর রিপোর্ট অনুসারে ২০২০ সালের শুরুতে সিলিকন ভ্যালির আমানত ছিল ৬০ বিলিয়ন ডলার, যেটি দুই বছর পরে এসে দাঁড়ায় ২০০ বিলিয়ন ডলারে! আলোচিত সিলিকন ভ্যালি আগে থেকেই প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে বেশ আগ্রহী ছিল এবং বড় বিনিয়োগ ছিল এই খাতে। প্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের (স্টার্ট আপ) যে ঋণ দেওয়া হয়, সেটায় মুনাফার হার থাকে অনেক বেশি এবং সেই সঙ্গে ঝুকিও অনেক। এই খাতকেই মানি মার্কেটের ভাষায় বলা হয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল। আলোচিত ব্যাংক দুটির বড় বিনিয়োগ ছিল এই ভেঞ্চার লেন্ডারদের কাছে। ফরচুন ম্যাগাজিনের একটা রিপোর্ট অনুসারে, সেই বিনিয়োগ তাদের মোট বিনিয়োগের ৫৬%।
ব্যাপারটা দাঁড়াল এই, একদিকে ফেডারেল রিজার্ভ বন্ডের সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ায় সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগের অ্যাসেট ভ্যালু কমে গেল মারাত্মকভাবে; অন্যদিকে স্টার্টআপ ক্যাপিটালে যে বিনিয়োগ ছিল, সেটি ফেরত আসছিল ধীরগতিতে। ফলে সিলিকন ভ্যালি পরিস্থিতি সামাল দিতে তার হাতে থাকা বন্ড থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের বন্ড বিক্রি করে দেয়। যেখানে সিলিকন ভ্যালির লস হয় ১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ঘাটতি সামাল দিতে পরিকল্পনা করে শেয়ার ছেড়ে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের ক্যাপিটাল বাড়ানোর। কিন্তু বাজারে প্যানিক তৈরি হয়ে যায় এর মধ্যেই। ইনভেস্টররা টাকা তুলে নিতে শুরু করে এবং রেকর্ড পরিমাণ অর্থ তুলে নেয় এক দিনে। অবধারিতভাবেই অবসায়নে চলে যায় ব্যাংকটি।
আমি ঠিক নিশ্চিত নই, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মে একটা ব্যাংক আমানতের কতটা দীর্ঘমেয়াদি খাতে এবং হাইরিস্ক ভেঞ্চার ক্যাপিটালে ইনভেস্ট করতে পারবে। একটা দেশের ১৬তম র্যাঙ্কিংয়ের ব্যাংক হঠাৎ দেউলিয়াই যদি হয়ে যাবে, ব্যাসেল থ্রি টাইপ ক্যাপিটাল এডিকোয়েসির নির্দেশনা কী কাজে এলো?
যা হোক, আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের সঙ্গে এই বিগ ফলের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের অযাচিত হস্তক্ষেপে নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা হাপিশ করে দেওয়া। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ফলে তারল্য সংকটে পড়ছে ব্যাংকগুলো। তারল্যই হচ্ছে ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার মেরুদণ্ড। ফলে আমেরিকার এই আকস্মিক পতনের মতো ঘটনা আমাদের দেশে ঘটার আশঙ্কা নেই। তবে এ পতন থেকে শিক্ষা নিতে হবে– আমানতকারী যদি একবার আস্থা হারিয়ে লাইন ধরে কোনো ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিতে শুরু করে, তাহলে সেই ব্যাংকের পতন ঠেকানো অসম্ভব। বাংলাদেশে যখন রিউমার উঠেছিল, তখন সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছিল দেশের সবচেয়ে বেশি মৌল ভিত্তিসম্পন্ন ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ নগদ সহায়তা (ঋণ) দিয়েছে, সেটি নজিরবিহীন। কিন্তু সেটি না করলে গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থাই ধাক্কা খেত। ফলে বলতেই হবে, পছন্দ না হলেও ইসলামী ব্যাংককে সাপোর্ট দেওয়া একটা স্মার্ট সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেটিকে পুঁজি করে যদি ব্যাংক তার বেপরোয়া বেনামি ঋণ দেওয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে আলটিমেট ভাগ্য বরণ করে নিতেই হবে সিলিকন ভ্যালি কিংবা সিগনেচার ব্যাংকের মতো। কারণ ব্যাংকের মূল ক্যাপিটালই হচ্ছে সাধারণ মানুষের আস্থা। সেটায় টান পড়লে দুই দিনেই যে কোনো ব্যাংক ধসে যেতে বাধ্য।
দেব প্রসাদ দেবু: সাবেক ছাত্রনেতা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।