সি-স্টার থেকে সি-কিউকাম্বার: সেন্ট মার্টিনের বিচিত্র সামুদ্রিক জীবন

সেন্ট মার্টিন

সমুদ্রফুল দেখেছেন কখনো? এগুলো আসলে শক্ত কঙ্কালবিহীন একধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। নাম সি-অ্যানিমোন। বর্ণিল ফুলের মতো দেখতে। এ জন্য সমুদ্রের ফুলও বলেন অনেকে। বেশির ভাগ সময় সমুদ্রের তলদেশে পাথর বা প্রবালের গায়ে লেগে থাকে। যখন কোনো শিকার, যেমন ছোট মাছ এদের খুব কাছাকাছি আসে, তখন কর্ষিকা ব্যবহার করে শিকারের দেহে বিষাক্ত ফিলামেন্ট ঢুকিয়ে দেয় এরা। ফলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে শিকার। তখন এরা কর্ষিকা দিয়ে এই নিষ্ক্রিয় শিকার মুখের ভেতর টেনে নেয়।

সেন্ট মার্টিন

 

সেন্ট মার্টিনে ফুল যেমন আছে, তেমনি আছে সমুদ্রপাখা বা সি-ফ্যান। এগুলো একধরনের নরম প্রবাল। হাতপাখার মতো আকৃতি দেখে সহজেই চেনা যায়। বাস করে দলবদ্ধভাবে। দেখতে দারুণ সুন্দর। শাখা-প্রশাখাযুক্ত ও চ্যাপটা দেহগঠন। দেহের উপরিভাগ নরম টিস্যু দিয়ে আবৃত। পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ প্রজাতির সি-ফ্যান পাওয়া যায়। একেকটি সি-ফ্যান আসলে অনেকগুলো সমুদ্র পলিপের কলোনি। প্রতিটি পলিপ শূন্য দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা আরও ছোট হয়। এদের ভেতরে বিশেষ একধরনের যন্ত্রণাদায়ক কোষ থাকে। সি-ফ্যান এই পলিপ ব্যবহার করে ছোট ছোট খাদ্যকণা, যেমন প্লাঙ্কটন বা ব্যাকটেরিয়া শিকার করে খায়।

জেলি ফিশের নাম সম্ভবত প্রায় সবাই শুনেছেন। এগুলো ছাতা বা ঘণ্টা আকৃতির মুক্ত সাঁতারু সামুদ্রিক প্রাণী। কোনো মস্তষ্ক, হৃৎপিণ্ড, হাড় বা চোখ নেই। কিছু প্রজাতির জেলি ফিশ স্পর্শ করলেও মানুষের বড় যন্ত্রণা হয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, এই জেলি ফিশগুলো প্রাণী হিসেবে অমর। একটি জেলি ফিশ কাটা পড়ে দুই খণ্ড হয়ে গেলে প্রতিটি খণ্ড থেকে একটি করে নতুন জেলি ফিশ তৈরি হতে পারে। তবে অমর হলেও শিকারে পরিণত হয় জেলি ফিশ। অনেক বড় আকারের সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন বড় মাছ ও কচ্ছপ এদের খেয়ে ফেলে। এমনকি কিছু প্রজাতির জেলি ফিশ অনেক দেশের মানুষেরও মজার খাদ্য।

এ রকম আরেকটি সুপরিচিত প্রাণী সমুদ্রতারা বা সি-স্টার। তবে সাধারণত এরা স্টারফিশ বা তারা মাছ নামে বেশি পরিচিত। নাম শুনেই বোঝা যায়, দেখতে তারার মতো। অমেরুদণ্ডী এই সামুদ্রিক প্রাণীর দেহের কেন্দ্রে একটি কেন্দ্রীয় চাকতি থাকে। এই চাকতি থেকে সাধারণত পাঁচটি বাহু বের হয়। তবে কিছু প্রজাতিতে ২৫টি পর্যন্ত বাহু থাকে। নলের মতো পা আছে এদের। এই নলাকার পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে যেকোনো দিকে চলাচল করতে পারে। মজার বিষয় হলো কিছু প্রজাতির তারা মাছে ছিঁড়ে যাওয়া বাহুখণ্ড অথবা সম্পূর্ণ বাহুই পুনরায় গড়ে উঠতে দেখা যায়। তারা মাছের গড় আয়ু ৩৫ বছরের মতো।

এবার একটি শামুকজাতীয় প্রাণীর কথা বলি যা সেন্ট মার্টিনে দেখতে পারবেন। এদের নাম নুডিব্রাঙ্ক বা সি-স্লাগ। নরম দেহের সামুদ্রিক গ্যাস্ট্রোপোড বা শামুকজাতীয় মলাস্কের একটি গ্রুপ এরা। ‘নুডিব্রাঙ্ক’ শব্দের অর্থ উন্মুক্ত ফুলকা। লার্ভা দশার পর প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এদের খোলস অদৃশ্য হয়ে যায়, উন্মুক্ত হয়ে পড়ে দেহ। দারুণ আকর্ষণীয় রং এদের। আকৃতির বৈচিত্র্যের কারণে সুপরিচিত। খোলস না থাকায় উজ্জ্বল রং এবং ঝাঁজালো গন্ধের ওপর নির্ভর করে শিকারিদের দূরে রাখে এগুলো।

এ রকম অদ্ভুত আরেকটি প্রাণীর নাম সি-কিউকাম্বার বা সমুদ্রশসা। না, সত্যি সত্যি শসা নয়, দেখতে শসার মতো। সে জন্যই এমন নাম। দেহ নরম, যদিও দেহপৃষ্ঠের নিচে কিছু অস্থি থাকে। অনেক সমুদ্রশসা তাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো পায়ুপথ দিয়ে বের করে ফেলে দেয়। পরে আবার উৎপন্ন করে নতুন করে। এদের কোনো মস্তিষ্ক নেই! নিশ্বাস নেয় পায়ু দিয়ে।
সাধারণত বিভিন্ন ধরনের পণ্য, যেমন ওষুধ ও সম্পূরক খাদ্যবস্তু তৈরিতে এদের ব্যবহার রয়েছে। কাঁকড়ার নাম শোনেনি, এমন কাউকে বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এখানে বিশেষ একধরনের কাঁকড়ার কথা বলব। ইংরেজিতে এদের হারমিট ক্র্যাব বলা হয়। বাংলায় অনেক সময় ‘ঋষি কাঁকড়া’ বা ‘শামুক কাঁকড়া’ বলে।
এরা নিজেদের নরম দেহকে রক্ষার জন্য সাধারণত সামুদ্রিক শামুকের ফাঁকা খোলসের ভেতর বাস করে। হারমিট ক্র্যাব আবর্জনাভোজী। মৃত প্রাণী বা যেকোনো কিছু পেলেই খায়। হারমিট ক্র্যাব ভালো খোলস পাওয়ার জন্য প্রায়ই খোলস পরিবর্তন করে। মজার বিষয় হলো এই খোলসের জন্য অন্য হারমিট ক্র্যাবদের সঙ্গে এদের মারামারিও বেধে যায় অনেক সময়।