জুমবাংলা ডেস্ক : বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় ১০ বছর আগেও দৈনিক ২০০ থেকে আড়াইশ টাকা মজুরিতে টাইলস মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন গোলজার রহমান (৪০)। কিন্তু দাদন ব্যবসায় জড়িয়ে গত এক দশকে ফুলেফেঁপে উঠেছে তার ভাণ্ডার।
ভাঙাচোরা টিনশেডের ঘর বদলে করেছেন আলিশান পাকা বাড়ি, বাড়িয়েছেন প্রতিপত্তি। এমনকি সুদের টাকা আদায়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীও। তার দাদনের চক্রে জড়িয়ে কেউ হয়েছেন এলাকাছাড়া, কেউবা হয়েছেন সর্বস্বান্ত।
এদিকে সম্প্রতি গোলজার বাহিনীর কারণে মারা গেছেন বগুড়া গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের পাররানীরপাড়া গ্রামের দিনমজুর আব্দুল মালেক (৪৬)। সুদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় তার স্ত্রী রিমা বেগমকে বাঁশঝাড়ে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করেন গোলজার ও তার বাহিনী। অনৈতিক কাজ করিয়ে টাকা আদায়ের হুমকিও দেন। শেষ পর্যন্ত লজ্জায়-অপমানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রিমা বেগমের স্বামী আব্দুল মালেক। এ ঘটনায় রোববার (০৯ জুলাই) সকালে মালেকের স্ত্রী রিমা বেগম বাদী হয়ে দাদন ব্যবসায়ী গোলজার রহমানসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন।
এজাহার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়নের পাররাণীরপাড়া গ্রামের আব্দুল মালেকের স্ত্রী রিমা বেগম তার স্বামীকে না জানিয়ে গোপনে পার্শ্ববর্তী চকবেড়া গ্রামের মৃত আকোমুদ্দিনের ছেলে গোলজার রহমানের কাছ থেকে গত ৪ মাস আগে ৩৬ হাজার টাকা সুদের ওপর ধার নেন। গোলজার জামানত হিসেবে রিমা বেগমের কাছ থেকে দেড় ভরি সোনার গহনা এবং ২টি অলিখিত চেকের পাতা নেন। সেই ৩৬ হাজার টাকা এখন সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার টাকায়। এই ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধের জন্য গোলজার গৃহবধূ রিমাকে চাপ দিতে থাকেন এবং স্বামী আব্দুল মালেককেও বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে আব্দুল মালেকের বাড়ি থেকে গত ০৬ জুলাই সন্ধ্যায় রিমাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে সারারাত বাঁশঝাড়ে আটকে রাখেন।
পরদিন ০৭ জুলাই রিমা বেগমের বাবা উনচুরখী গ্রামের আব্দুর রহিম প্রামানিক গরু বিক্রি করে ৭৫ হাজার পরিশোধ করেন। এরপরেও রিমার গচ্ছিত গহনা ও চেকের পাতা ফেরত দেওয়ার জন্য স্বামী আব্দুল মালেকের কাছ থেকে আরো টাকা দাবি করে বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দেন গোলজার। এ ঘটনায় ক্ষোভে-অভিমানে আব্দুল মালেক ০৮ জুলাই দিবাগত রাতে তার ঘরে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। আব্দুল মালেকের দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, আব্দুল মালেক একজন পরহেজগার মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। তাই নিজের অপমান-অপদস্থ আর স্ত্রীকে সারারাত বেঁধে রাখার বিষয়টি মেনে নিতে না পেরেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় রিমা বেগম বাদী হয়ে রোববার (০৯ জুলাই) থানায় একটি মামলা দায়ের করলে পুলিশ ওইদিন গোলজারকে গ্রেপ্তার করে।
পাররানীরপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, শুধু রিমা বা মালেক নন, সুদের জন্য গোলজারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও অনেকে। গ্রামের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা হোরা প্রামাণিকের মেয়ে বছর পাঁচেক আগে গোলজারের কাছ থেকে সুদের ওপর ১ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। পরে অব্যাহত চাপে মেয়ের দেনা শোধ করতে ভিটেমাটি বিক্রি করে ১১ লাখ টাকায় মীমাংসা করেন হোরা মিয়া। তবু আরও টাকার দাবিতে চলতে থাকে হুমকি-ধামকি। বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান হোরা মিয়া। মুদি ব্যবসায়ী রাজ্জাক প্রামাণিকও ১ লাখ টাকা সুদের ওপর ধার নিয়েছিলেন গোলজারের থেকে। তিন বছর ধরে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা সুদ দিয়ে এখন নিঃস্ব রাজ্জাক।
রাজ্জাক প্রামাণিক জানান, গরীব অসহায় মানুষকে সুদের ওপর টাকা ধার দেন গোলজার। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন তিনি। কেউ সুদের টাকা পরিশোধে গড়িমসি করলে তাকে হয়রানি করে গোলজারের বাহিনী।
মামলার বাদী ও নিহত মালেকের স্ত্রী রিমা বেগম জানান, অভাবের জ্বালায় গোলজারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলাম। কে জানত সেই টাকা আমার স্বামীকে কেড়ে নেবে। বৃহস্পতিবার রাতে গোলজার ও তার দলবল সুদের টাকার জন্য আমাকে বাঁশঝাড়ে বেঁধে মারধর করেন। আমার বাবা জানতে পেরে গরু বিক্রি করে টাকা দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নেন। আমার স্বামী-সম্মান সবই গেল। আমি গোলজারের বিচার চাই।
এলাকাবাসী আরও জানান, গোলজার হোসেন একসময় টাইলস মিস্ত্রির সহকারী ছিলেন। বছর ১০ আগে পুরোনো একটি বাইসাইকেল চালিয়ে বগুড়া শহরে কাজের সন্ধানে যেতেন। সারা দিন কাজ করে ফিরতেন সন্ধ্যায়। চড়া সুদের ব্যবসায় রাতারাতি ভাগ্য খুলে যায় তার। শৈশব থেকে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট গোলজার। তিনি এখন দামি মোটরসাইকেলে চলাফেরা করেন। এক কোটি টাকার বেশি তিনি চড়া সুদে দাদন দিয়েছেন। এক হাজার টাকার জন্য প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা তাকে সুদ দিতে হয়। সুদ দিতে না পারলেই তার বাহিনী দিয়ে যারা সুদে টাকা নিয়েছেন, তাদের নির্যাতন করা হয়।
উপজেলার বেড়েরবাড়ি, পার রানীরপাড়া ছাড়াও আশপাশে ১০-১২টি গ্রামের লোকজন দাদন ব্যবসায়ী গোলজার রহমানের চড়া সুদের চক্রে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। গোলজার এসব গ্রামের কয়েক শ’ বাসিন্দার কাছে কোটি টাকা দাদন দিয়েছেন। টাকা ধার দেওয়ার সময় ফাঁকা চেক, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেওয়া হয়। এক লাখ টাকা ধার নিতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা অফিস খরচ দিতে হয়। এরপর প্রতি মাসে ২০-৩০ শতাংশ হারে সুদ আদায় করা হয়। কোনো মাসে সুদ দিতে না পারলে মূলধনের সঙ্গে সেটি যোগ হয়। পরের মাসে মূলধন ও সুদ মিলে ঋণের টাকা আদায় করা হয়। এভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে সুদ। টাকা শোধ দিতে না পারলে গোলজার বাহিনীর ১০-১২ জন সদস্য বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বসতবাড়ি দখলের হুমকি দেন, মারধর করেন।
গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সনাতন চন্দ্র সরকার জানান, গৃহবধূর করা মামলায় অভিযুক্ত গোলজারকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। গোলজার সুদের ব্যবসা করে বিপুল অর্থবিত্ত গড়েছেন বলে পুলিশও তথ্য পেয়েছে।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আখতার জানান, গ্রেপ্তার গোলজারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। নির্যাতনে জড়িত অন্যরা পলাতক। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।