জুমবাংলা ডেস্ক: সুন্দরগঞ্জ তথা গাইবান্ধা অঞ্চলের মানুষ মেতেছে বৈত উৎসবে। ছোট বড় তথা সব বয়সী মানুষের একসঙ্গে হয়ে খাল, বিল, ছড়া, নদী কিংবা নালাতে মাছ ধরার নামই বৈত। একে কোথাও কোথাও বউত, বৌত বা বাউতও বলে। আবার কোথাও কোথাও পলো বাইচ বা পলো বাওয়া নামেও ডাকা হয়। ভাদ্র মাস থেকে শুরু হয়ে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত চলে বৈত উৎসব। মাছ পাক বা না পাক নির্ধারিত দিনে এ উৎসবে যোগদানে আগ্রহীরা উপস্থিত হবেই নির্ধারিত স্থানে। এরপর বৈত সর্দারের ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই হৈ-হুল্লোড়ে নেমে পড়ে জলাশয়ে। আর থেমে থেমে চলবে বৈতারীদের (বৈতারীদের বৈতালও বলে) সানন্দে চিৎকার— হৈ— রে—! এ বৈত কিন্তু কারো ব্যক্তিগত জলাশয়ে হয় না, খাস বা সরকারি জলাশয়ে হয়।
যাহোক, সর্দারের ইঙ্গিত আগে মহিষের শিঙ এর তৈরি শিঙায় ফুঁ দিয়ে শুরু হত। তবে এখন বাঁশির ফুঁ কিংবা উচ্চস্বরের হাঁকেই এ কাজ শুরু হয়। আর আগ্রহীদের জমায়েত করার পদ্ধতি এখন মোবাইল ফোন। বৈতারীরা কিন্তু সর্দার হিসেবে একজনকে মেনে চলে। আর এ সর্দার হন গোটা উপজেলা বা অঞ্চলের একজন, আবার ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ের একজন। আর উপজেলা সর্দার ইউনিয়ন বা গ্রাম সর্দারকে বৈতের দিন-তারিখ ও স্থান জানিয়ে দিলেই একে অপরের থেকে সংবাদ পৌঁছে যায় আগ্রহীদের নিকট। অবশ্য আগে হাটে ঢোলাই করে কিংবা মাইকিং এর মাধ্যমে জানানো হত। যাহোক সংবাদ পেলেই নির্ধারিত দিনে বৈতারীরা সবাই যথাস্থলে উপস্থিত হয়।
এতে শোখিন মৎস্য শিকারী বা মৎস্যজীবী কিংবা আগ্রহী যে কোনো ব্যক্তি তারা যেকোনো বয়সই হোক, এতে অংশ নেয়। তাদের হাতে থাকে পলো, কোঁচা, চাক, ছোট বড় মুঠজাল, ঝিটকি জাল, চালুন, হেঙ্গা জাল সহ বিভিন্ন রকমের মাছ ধরার যন্ত্রপাতি। কেউ হেঁটে, কেউ অটো চেপে, কেউ মটর সাইকেলে, কেউ সাইকেলে চেপে উপস্থিত হন। আর সে আগমন যেন হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার ডাকের মতন! যে যেমন করে যে পথে পাচ্ছেন নির্ধারিত জায়গায় দলবেঁধে/সারিবেঁধে কিংবা দলছুটে যেন পিল পিল করে আসছেন!
সৌখিন মৎস্যশিকারী বাবু ভক্ত জানান, আমি ছোটবেলা থেকেই বৈতে যাই। মাছ পাই বা না পাই খুব মজা হয়। বহু মানুষের সাাৎ হয়। আনন্দে হেসে বলেন, আগন মাসে নয়া ধানের চাউলের ভাত আর বৈতের মাচের ঝোল— ! ঢোক গিলে বলেন, মজা কত!
আরেক সৌখিন মৎস্য শিকারী আবুল মিয়া জানান, ভাদর মাস থাকি প্রস্তুত হামরা। সর্দার যেই সংবাদ দেয় হামরা চলি। একটু থেমে স্মৃতি হাতরানোর মত করে বলেন, সর্দারের মত সর্দার আছিল ঘেচু সর্দার (ঘেচু মুন্সী) । শুনছি, একবার নাকি কোন বিলত বৈত নামছে আর একজন মালিক সাজিয়া বাধা দিয়া আদালতত দরখাস্ত দিচিল। তো হাকিম উপস্থিত হবার জন্যে অর্ডার করচে। শুনিয়া ঘেচু সর্দার নাকি তামান হাটে ঢোল দিয়া এ ঘটনা জানেয়া আদালত উপস্থিত হবার কইচে। আর বলে যার যে মাছ মারা অস্ত্র আচিল তাকে নিয়া শ’য়ে শ’য়ে বৈতের মানুষ গাইবান্ধা আদালত চত্বরত হাজির। তাক দেখিয়া হাকিম সাহেব অবাক। হাকিম সাহেব কয়, এ ভাবে মাছ মেরে কি করেন? সর্দার উত্তর দেয়, স্যার হামরা আনন্দে ধরে খাই। তবে কারো ব্যক্তিগত জলাশয়ত যাই না।
শুনে হাকিম বলেন, ঠিক আছে আমি তোমাদের মাছ মারা দেখতে যাব! তারপর দেখিয়া একবারে মামলা খারিজ করি দেয়। সাগ্রহে জানতে চাই, সুন্দরগঞ্জে কতটা বিলে বৈত হয়? বলেন, আগের মত আর বিল, জলাশয় নাই। হয় পুরি উটচে, না হয় লিজ নিচে কেউ! তাও পনেরো বিশটা তো এলাও আচে। তার মধ্যে গানড্রার বিল, বান্নীর ছড়া, পাচুয়ার বিল, মাঠের হাটের ছড়া, ছতরাইল, গাবের তলের ছড়া, মরুয়া দহের ছড়া নাম করা। তবে এবার মাছ কম রে ভাই। কেননা, বিষ্টি কম হইচে মসমত। আর ভাসাভাসি বানও হয় নাই।
বয়সের ভারে ন্যূজ হাকমত আলী পলো ঘারে নিয়েই জানান, ষাট বচর থাকি বৈত মারি। আগে কত বড় বড় মাছ পাইচনো! দৃষ্টি যেন অতীতে নিয়ে গিয়ে বলেন, সেই মাছ কি এলা আছে! এলা এক কেজি একটা শোল পাইলে সগারই চোকত আনন্দ ঝলকানি মারে!
এ বৈতমারা সত্যিই আনন্দের। কেননা একখানে অনেক মানুষের সমাগম আর মজা, দেখলেই মন আনন্দে ভরে ওঠে! তবে শুধু যারা বৈত মারে তারাই না, দেখার জন্যও উৎসুক মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মত!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।