নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর : আব্দুস সোবহান ওরফে সুবু। বয়স ৭০’র গন্ডি পেড়িয়েছেন বছর ৫ আগেই। সাদা রঙ ধারণ করেছে মাথার সবকটি চুল। মুখ ভর্তি দাড়িরও একই অবস্থা। মাথার উপর ৪০ হাজার টাকা এনজিও’র ঋণের বোঝা। আর সেই ঋণ শোধ করতে ৭৫ বছর বয়সেও থেমে নেই সুবু। ঋণ আর রুটি-রুজির জন্য এই বয়সেও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত করেন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম।
জীবনযুদ্ধে পরাজয় মানতে নারাজ পঁচাত্তর বয়সী আব্দুস সোবহান। প্রতিদিন সকালে মানুষের বাসায় গিয়ে ভাঙছেন ইট। বিকেলে রাস্তা বা সড়কের ধারে বিক্রি করছেন পিঠা।
বয়স যখন পাঁচ, তখন বাবা আব্দুল মাজেদকে হারান। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সুবু সবার বড় হওয়ায় তার দায়িত্বও ছিল বেশি। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে মাত্র সাত বছর বয়সে স্থানীয় একটি রাইসমিলে কাজ শুরু করেন। মা, ভাই ও বোনদের বড় করেন। এর মধ্যে চার ভাই জমি-জমা বিক্রি করে মা ও তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।
টানা ২৭ বছর রাইসমিলে কাজ করেন এই জীবনযোদ্ধা। শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা সেই রাইসমিলটিও অবশেষে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুরু করেন ইট ভাঙার কাজ। এরই মধ্যে শৈশব, কৈশোর পেড়িয়ে যুবকে পরিণত হন সুবু। বিয়ে করেন।
ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ইট ভেঙে ১৫০-২০০ টাকা আয় হয় সুবুর। বিকেলে রাস্তা বা সড়কের ধারে পিঠা বিক্রি করে ১০০-১৫০ টাকার মতো রোজগার হয়। সব মিলিয়ে প্রতিদিন তার রোজগার হয় প্রায় ৩০০ টাকা। এ দিয়েই চলে স্বামী-স্ত্রী দুজনের সংসার। দেন সাপ্তাহিক এনজিওর কিস্তি। বয়োবৃদ্ধ এই মানুষটির কাজের ফাঁকে ফাঁকে শোনান জীবনের গল্প।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌর এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের খঞ্জনা গ্রামে জন্ম নেয়া আব্দুস সোবহান ওরফে সুবু চার মেয়ে ও দুই ছেলের জনক। চার মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে শারীরিক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সেই মেয়ে বাড়িতে থাকে না, ঘুরে বেড়ায় রাস্তায় রাস্তায়। বাকি তিন মেয়ে ও দুই ছেলের বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলের একজন সৌদিপ্রবাসী। অন্যজন স্থানীয় একটি ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করেন। ছেলে-মেয়ের কেউই তাদের বাবা-মায়ের খোঁজ নেন না। এ বয়সেও তাকে সকাল-সন্ধ্যা করতে হয় হাড়ভাঙা পরিশ্রম।
ছোটবেলায় লেখাপড়া করার প্রবল আগ্রহ ছিল সুবুর। কিন্তু দারিদ্র্যতার কারণে তিনি তা করতে পারেননি। ইচ্ছা ছিল সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন। তাতে ছেলে-মেয়ের কারোর আগ্রহ ছিল না। সবার ছোট মেয়ে তাসলিমার আগ্রহ থাকায় তাকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করিয়েছেন।
সুবুর বাড়ির ভিটেমাটি বলতে মাত্র এক কাঠা জমি। বছর দেড়েক আগে বাকি জমিজমা বিক্রি করে এক ছেলেকে পাঠানো হয়েছে সৌদি আরবে। এরপরই শুরু হয় করোনাভাইরাসের তাণ্ডব।
বর্তমানে বাড়ির যে জমিটুকু আছে বর্ষাকালে তা পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। এজন্য স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নেন সুবু। সেই টাকার কিছু অংশ দিয়ে বাড়িতে একটি সাবমারসিবল পাম্প (গভীর নলকূপ) স্থাপন করেন এবং বাকি টাকা দিয়ে বাড়িতে বালি ফেলে উঁচু করেন। সেই ৪০ হাজার টাকার প্রতি সপ্তাহের কিস্তি হিসেবে দিতে হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকা। এজন্য সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হচ্ছে এই বৃদ্ধকে।
আব্দুস সোবহান ওরফে সুবু এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাথার ওপর ঋণের বোঝা। এ ঋণ পরিশোধের জন্য আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ইটভাঙার কাজ করি। বিকেলে রাস্তার পাশে বসে পিঠা বিক্রি করি। এ দিয়েই কিস্তির টাকা আর দুজনের সংসার খরচ চলে।’
সারাদিনে দুই কাজে ৩০০ টাকা রোজগার হলেও সংসার চালানো আর কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয় সুবুকে। এই জীবনযোদ্ধা মনে করেন, কোনোমতে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারলে পরে প্রতিদিনের যে রোজগার হবে, তা দিয়েই সংসারের খরচটা চালিয়ে নেবেন। এখন ঋণ পরিশোধকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন পরিশ্রমী এই বৃদ্ধ। পারবেন ঋণ পরিশোধ করে কোনোমতে দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।