জুমবাংলা ডেস্ক: অধিকাংশ সময়ই মানুষ ভুলে যায় যে, তার শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, প্রতিভা ও যোগ্যতা তার নিজের ক্ষমতাবলে পাওয়া নয়; বরং তা মালিকের দান। তিনি দিয়েছেন। চাইলে আবার ছিনিয়েও নিতে পারেন। তাছাড়া মানুষের শক্তি, সুস্থতা ও যোগ্যতার ব্যবহারও আল্লাহ তাআলার দয়া ও তাওফীকের উপর নির্ভরশীল। মানুষের কৃত কল্যাণকর কাজ নিজের শক্তিবলে নয়; বরং দয়ালু ও মহান প্রতিপালকের দয়া ও করুণার কারণেই সম্পাদিত হয়।
জামে তিরমিযীর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কিয়ামতের দিন বিপদগ্রস্ত লোকদেরকে যে মহা পুরস্কার দেয়া হবে তা দেখে আফিয়াতের অধিকারী লোকেরা কামনা করবে, হায়! দুনিয়াতে যদি তাদের দেহ কাঁচি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হত (আর তার বিনিময়ে আখেরাতের এ মহা পুরস্কার লাভ হত) -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪০২।
অসুস্থতার সময় নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা মানুষের কাছে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠে। শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, আভ্যন্তরীণ প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার মিথ্যা অহমিকা অনেকেরই আছে। কোনো অভিনব সৃষ্টিশীল কাজ করে নিজের দিকে তা সম্পৃক্ত করে পুলক অনুভব করার মানসিকতা আছে সবারই। কখনো কোনো বড় কাজ করতে পারলে বুদ্ধির অপরিপক্কতা ও অপূর্ণতার দরুন উজ্ব ও অত্মমুগ্ধতার শিকার হয়ে যায় অনেকেই। কখনো এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা এ পর্যায়ে পৌঁছে যে, ব্যক্তি নিজেকেই নিজের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক ও সর্বেসর্বা মনে করে বসে। অথচ মানুষ এতটাই দুর্বল ও অক্ষম যে, তাকে পরাভূত করার জন্য ছোট্ট একটা পাখীই যথেষ্ট।
যদি এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তাওফীকের ছায়া উঠিয়ে নেন তাহলে মানুষ এক পাও উপরে উঠাতে পারবে না। যেমনিভাবে বিদ্যুৎ ছাড়া কারখানার সকল মেশিন অচল পড়ে থাকে তেমনিভাবে আল্লাহর দয়া ও তাওফীক ছাড়া মানুষের সকল প্রতিভা ও যোগ্যতা অচল পড়ে থাকবে। মানুষের অস্তিত্ব, শারীরিক-আত্মিক সকল শক্তি ও প্রতিভা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার হেফাযত ও তত্ত্বাবধানের মুখাপেক্ষী। তিনি যদি হেফাযতের কুদরতি চাদর একটুখানি উঠিয়ে নেন তাহলে মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সকল প্রতিভা ও যোগ্যতা মূল্যহীন হয়ে পড়বে। মানুষ দুর্বল কোনো পাখী কিংবা কীট-পতঙ্গ থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে পারে না।
قُلْ مَنْ یَّكْلَؤُكُمْ بِالَّیْلِ وَ النَّهَارِ مِنَ الرَّحْمٰنِ.
বল, রাতে ও দিনে দয়াময় ছাড়া আর কে তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে।-সূরা আন্বিয়া (২১) : ৪২
মোটকথা মানুষের সবকিছুই মহান মালিকের দান। মানুষ যেমন নিজের অস্তিত্বের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী তেমনি নিজের হেফাযত ও নিরাপত্তা এবং বাহ্যিক ও ভেতরগত সকল শক্তির সঠিক ব্যবহারের জন্যও তাঁর মুখাপেক্ষী।
মানুষের সকল গুণই অপসৃয়মান। এখন হয়ত আছে কিছুক্ষণ পর আবার দূর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অক্ষমতা, দুর্বলতা ও মুখাপেক্ষিতা মানবজীবনের এমন অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা এক মুহূর্তের জন্যও দূর হয় না। প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে এ বিশ্বাস থাকলেও বিশ্বাসের উপলব্ধি জাগরুক নেই অনেকের মাঝেই।
হযরত আরেফ বিল্লাহ ড. আবদুল হাই রাহ. অনেক সময় বলতেন, আমলকে যদি নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত কর তাহলে এর জন্য পস্তাতে হবে তোমাকে। যদি নেক আমল কর তাহলে তো উজ্ব ও গর্বে ফুলে উঠবে। আর যদি আমলের মধ্যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তাহলে হতাশ হয়ে আমলের হিম্মতই হারিয়ে ফেলবে। হযরত বলতেন, সবসময় আমলকে আল্লাহ্র দিকে নিসবত কর। তাঁর দান এবং ইহসান মনে কর। এতে মনে কখনো আত্মগর্ব জাগবে না। আবার কখনো হতাশও হবে না। কোনো কামাল বা পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি গেলে সাথে সাথে শুকরিয়া আদায় করে বল-
الحمد لله، اللهُم لَكَ الْحَمْدُ ولك الشكر.
হে আল্লাহ! আপনার শুকরিয়া, আপনি এ মহা নিআমত আমাকে দান করেছেন। আর যদি কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তাহলেও মালিকের দান মনে করে তার সঠিক মূল্যায়ন করবে।
পবিত্র কুরআনের ইরশাদ-
وَ اِنْ تَعُدُّوْا نِعْمَتَ اللهِ لَا تُحْصُوْهَا اِنَّ الْاِنْسَانَ لَظَلُوْمٌ كَفَّارٌ.
তোমরা আল্লাহ্র নিআমত গণনা করে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ অকৃতজ্ঞ ও নাফরমান। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৪
শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, ‘আল্লাহ তাআলার নিআমত এত অসংখ্য যে, যদি তোমরা সবাই মিলে ভাসাভাসাভাবেও গণনা শুরু কর তাহলেও ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বে। শেষ অংশের ব্যাখ্যায় বলেন- ‘মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অকৃতজ্ঞ ও জালেম ঐ ব্যক্তি, যে এত অসংখ্য নিআমত দেখেও নিজের প্রকৃত ও মহান দাতার হক সম্পর্কে সচেতন হয়নি।
আমরা আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে কত অক্ষম! তাঁর একটি নিআমতের শুকরিয়াও আমাদের পক্ষে যথাযথভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। শুধু আফিয়াতের নিআমতের কথাই চিন্তা করুন। কত বিস্তৃত এই নিআমাত! কত অসংখ্য তার শাখা-প্রশাখা। এই অসংখ্য শাখা-প্রশাখার অধিকাংশের ক্ষেত্রেই আমাদের মনে হয় না যে, এরও শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
প্রতিটি মুহূর্তে আমরা কত নিআমতের মধ্যে ডুবে আছি। অনেক নিআমতের দিকে তো মানুষের দৃষ্টি যায় এবং কিছু না কিছু হলেও শুকরিয়া আদায় করে। কিন্তু লাখো-কোটি নিআমত এমন, যা মানুষের উপলদ্ধি- সীমারও বাইরে; সেগুলোর শুকরিয়া আদায় হবে কীভাবে? আমাদের এই দেহযন্ত্রের প্রতিটি অংশের জন্যই কি আলাদা আলাদাভাবে শুকরিয়া করা উচিত নয়? কিন্তু আমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যার দেহের কোনো একটি অঙ্গের সুস্থতা ও আফিয়াতের জন্য সার্বক্ষণিক শুকরিয়া আদায়ের সৌভাগ্য হয়েছে।
দিনের তুলনায় রাতের বেলা রোগের কষ্ট ও তীব্রতা সাধারণত বেড়ে যায়। এর কারণ এটা হতে পারে যে, দিনের কোলাহল ও কর্মের আয়োজনে অসুস্থতার প্রতি রুগীর মনযোগ থাকে না। কিন্তু যখন সকল আয়োজন ও কর্মচাঞ্চল্য শেষ হয়ে যায় তখন রাতের নির্জনতায় অসুস্থ ব্যক্তির সকল মনোযোগ নিবদ্ধ হয় রোগের প্রতি। তাই কষ্টের অনুভূতিও তখন বেড়ে যায়। আরেকটি কারণ এ-ও হতে পারে যে, রাত হচ্ছে বিশ্রামের সময়।
এজন্য স্বভাবগতভাবেই মানুষ রাতের বেলা একটু আরাম ও বিশ্রাম করতে চায়। তবে অসুস্থতা এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে কষ্টের অনুভূতিও দ্বিগুণ হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ- এক ব্যক্তি সুস্থ। শারীরিক কোনো রোগ তার নেই। সে ঘুমাতে চাচ্ছে। কিন্তু অন্য একজন তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। অনবরত কয়েক রাত এভাবেই কেটে গেল। সে হয়তো অসুস্থ নয়। কোন ব্যথা-বেদনাও নেই তার শরীরে। কিন্তু বিশ্রাম না করতে পারাটা তার জন্য অনেক বড় কষ্টের ব্যাপার। এখন যদি ব্যথা-বেদনার পাশাপাশি বিশ্রামের আনন্দ থেকেও বঞ্চিত থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এতে রোগীর কষ্ট আরো বেড়ে যায়। এসব কারণে রাত আসার কল্পনাই অসুস্থকে অস্থির করে তোলে। হায় আল্লাহ! রাত কাটাব কী করে!
অনুবাদে : শাহাদাত ছাকিব
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel