সূর্যের যত কাছাকাছি থাকা যাবে, উষ্ণতা তত বেশি হবে—এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ধরুন, একটা আগুনের চুল্লি জ্বলছে। আপনি চুল্লির যত কাছে যাবেন, তত বেশি গরম অনুভব করবেন। একইভাবে বলা যায়, চুল্লি থেকে দূরে সরে গেলে ধীরে ধীরে আর গরম লাগবে না।
কিন্তু ইউরেনাস ও নেপচুনের ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব খাটে না। কারণ, সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরের গ্রহ নেপচুন। সৌরজগতের ৮ম গ্রহ। সূর্য থেকে প্রায় ৪৪৮ কোটি ২২ লাখ কিলোমিটার দূরে। তার আগে অর্থাৎ সৌরজগতের ৭ম গ্রহ হলো ইউরেনাস যার দূরত্ব সূর্য থেকে প্রায় ২৯০ কোটি কিলোমিটার। অর্থাৎ গ্রহ দুটির মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১৫৮ কোটি কিলোমিটার। মানে সূর্য থেকে ইউরেনাস যতটা দূরে রয়েছে, নেপচুন রয়েছে তার চেয়েও ১৫৮ কোটি কিলোমিটার দূরে।
ইউরেনাস সূর্যের কাছে থাকায় নেপচুনের চেয়ে আলোও বেশি পায়। তাই ইউরেনাসের বেশি উষ্ণ থাকার কথা। কিন্তু ঘটেছে তার বিপরীত। নেপচুনের তাপমাত্রা মাইনাস ২১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও ইউরেনাসের তাপমাত্রা মাইনাস ২২৪ সেলসিয়াস। কেন হিসাবটা এমন উল্টে গেল? সূর্যের কাছে থেকেও কেন ইউরেনাস বেশি শীতল?
এর কারণ হিসেবে বিবিসি স্কাই নাইট ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, অতীতে ইউরেনাস গ্রহে বিশাল আকারের কোনো বস্তু আঘাত করেছিল। সেটা হতে পারে পৃথিবী বা মঙ্গল গ্রহের আকারের কোনো বস্তু। এই আঘাতের ফলে ইউরেনাস একদিকে হেলে পড়েছে। ফলে বদলে গেছে ঘূর্ণন গতি। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৯৭ ডিগ্রি হেলে পড়েছে। এতে সূর্যের আলো ঠিকভাবে পড়ছে না গ্রহটিতে।
ইউরেনাস গ্রহের এক বছর হয় পৃথিবীর প্রায় ৮৪ বছরে। অর্থাৎ প্রতি ৮৪ বছরে গ্রহটি একবার সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসে। যদি গ্রহটি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতো, তাহলে সূর্যের আলো গিয়ে পড়তো ইউরেনাসের পৃষ্ঠে। উষ্ণতা আরও বাড়ত। কিন্তু ৯৭ ডিগ্রি হেলে থাকায় গ্রহটির একপাশে সূর্যের আলো পড়লেও অন্য পাশ থাকে অন্ধকার। অনেকটা চাঁদের মতো। তবে চাঁদের মতো সারা জীবন একপাশে আলোকিত আর একপাশ অন্ধকার থাকে না।
যদি গ্রহটির উত্তর মেরু আলোকিত থাকে তাহলে দক্ষিণ মেরু অন্ধকারে থাকে ৪২ বছর। তারপর আবার ৪২ বছর পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ উত্তর মেরুতে অন্ধকার নেমে আসে এবং আলোকিত হয় দক্ষিণ মেরু। এভাবে চলার কারণে গ্রহটি বেশি তাপ পায় না। কিন্তু নেপচুনের এই সমস্যা নেই। সূর্য থেকে যতটুকু আলো পায়, তা সবটা গিয়ে পড়ে গ্রহের পৃষ্ঠে। ফলে বেশি উষ্ণ থাকে গ্রহটি।
এখন ভাবতে পারেন, এদের তাপমাত্রা নিয়ে এত কথা যে বলছি, গ্রহগুলোর তাপমাত্রা মাপা হলো কীভাবে? কেউ তো আর গিয়ে তাপমাত্রা মেপে আসেনি ইউরেনাস বা নেপচুনের। তাছাড়া শুধু ভয়েজার ২ নভোযান ছাড়া অন্য কোনো মিশনও পরিচালনা করা হয়নি এই দুই গ্রহে।
আসলে দূরত্বের কারণেই এখনো কোনো মিশন পরিচালনা করেনি পৃথিবীবাসী। এমনকি ১৯৮৬ সালে ভয়েজার ২ মিশন এই দুই গ্রহের উদ্দেশ্য পরিচালনা করা হয়নি। বরং চলার পথে ইউরেনাস ও নেপচুনের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে নভোযানটি। তাতে এই দুই গ্রহের থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে তাপমাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে।
কিন্তু নভোযান না পাঠিয়েও পৃথিবী থেকে যেকোনো গ্রহের তাপমাত্রা ধারণা করা যায়। কোনো গ্রহ থেকে আসা আলো পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে কতটা অণু ও পরমাণু রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অণু-পরমাণু হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো কাজ করে।
আবার ভাবতে পারেন, তাহলে ইউরেনাসই কী সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল জায়গা? এ প্রশ্নের উত্তরটা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা রয়েছে। অনেকে দাবি করেন, কোনোটায় বলা হয়েছে ইউরেনাস সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল স্থান। কিন্তু অন্যদের দাবি, ইউরেনাস নয় বরং চাঁদের একটা জায়গা হলো সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল স্থান।
চাঁদে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে হাজার হাজার কোটি বছর ধরে সূর্যের আলো পৌঁছায়নি। এরকম একটি স্থান হলো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে হারমাইট ক্রেটার। এখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ২৪৭ ডিগ্রি। ফলে সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল স্থান রয়েছে চাঁদে। কিন্তু সৌরজগতের শীতলতম গ্রহ ইউরেনাসকে বলাই যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।