খালেদ মুহিউদ্দীন: দুই দিন আগেই সারা দেশকে আনন্দে ভেসে যাওয়ার উপলক্ষ দিয়েছেন অধিনায়ক। ২৪ ঘণ্টা না যেতেই চমকে উঠেছি আমরা সবাই। আমাদের সোনার ছেলের দুবাইয়ে সোনার দোকান উদ্বোধনের খবরটি যে কত প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে!
পুলিশ হত্যায় অভিযুক্ত একজন কী করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারেন? কারা তাকে সহযোগিতা করেন? আদালতে আত্মসমর্পণ বা জেল খাটার সময়ও একজন অপরাধীকে কী করে বা কার সাহায্যে বদলে দেওয়া যায়? সীমানা পার হতে পারলেই ভারতীয় নাগরিক হওয়া যায়? দুবাইতে এত টাকা নেওয়া যায় কীভাবে? আরও যারা এই দেশের নাগরিক তারা কী করে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন? সাকিব আল হাসানের সঙ্গে আরাভ জুয়েলার্সের হয়ে কে যোগাযোগ করেছিল? পণ্যের বিপণনে সিলেক্টিভ হওয়ার সুযোগ আছে কি?
আরাভ জুয়েলার্স নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যান বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। খবরে প্রকাশ, ১৫ মার্চ ওই প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে না উঠেই ১০ মিনিটের মধ্যে চলে যান তিনি। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির মালিক আরাভ খান প্রধান ক্রেতাদের সাকিব আল হাসানের সই করা জার্সি ও ব্যাট উপহার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
আরাভ জুয়েলার্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক আরাভ খান এখন ভারতীয় নাগরিক। যদিও তার আসল পরিচয় তিনি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার ছেলে রবিউল ইসলাম। চার বছর আগে ঢাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি।
ফেসবুক পোস্টে এই আরাভ খানের ছবি দেখে পুলিশ চিনতে পারে, দুবাইয়ের এই স্বর্ণ ব্যবসায়ী মূলত বাংলাদেশে পুলিশ পরিদর্শক হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে পুলিশ।
পুলিশ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সে সময় ৩০ বছর বয়সি রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে৷ এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
কয়েক দিন আগে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান তারকাদের সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন রবিউল। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার নম্বর ৬৫১০৷ আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিকও তিনি। পাশাপাশি রয়েছে একটি সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও। সেখানে মাঝেমধ্যে মায়াবী হরিণ জবাই দিয়ে বাংলাদেশিদের দাওয়াত খাওয়াচ্ছেন। বাগানে চাষ করছেন বাংলাদেশি সবজি। রয়েছে একাধিক দামি গাড়ি। আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন উপলক্ষে ৬০ কেজি সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বাজপাখির আদলে লোগো, যা তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই মাস। এটা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
ওই ফেসবুক পোস্ট দেখে অনেকেই চিনে ফেলেন, তিনি বাংলাদেশে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি রবিউল ইসলাম। ফেরারি একজন আসামি দুবাইয়ে গিয়ে কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টাকায় দুবাইয়ে সোনার ব্যবসা শুরু করেন রবিউল ইসলাম।
দুবাই বিশ্বে স্বর্ণের ব্যবসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দুবাইপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি সেখানে স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন, আবার স্বর্ণের দোকানের মালিকানায়ও রয়েছেন কেউ কেউ। তবে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিরা দেশটিতে অর্থ পাচার করে ফ্ল্যাট, বাড়ি, তারকা হোটেল ইত্যাদি কিনছেন। কেউ কেউ স্বর্ণ ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করছেন। যদিও সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কাউকে দুবাইয়ের এসব ব্যবসায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি বলে জানা গেছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির আমন্ত্রণে ঢাকার বনানীর একটি বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মামুনকে ফাঁদে ফেলে বনানীর ওই বাসায় ডেকে নেওয়া হয়। তাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে বেঁধে, স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে মামুন মারা যান। পরে গাজীপুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ এ মামলায় রহমত উল্লাহ এবং রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেখানে রবিউল ইসলামকে পলাতক উল্লেখ করা হয়। পরে আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামের একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে জেলে পাঠান৷ প্রায় ৯ মাস কারাবাসের পর ওই তরুণ বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, তার আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউল ইসলামের কথামতো তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি।
এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। ডিবির অনুসন্ধানে জানা যায়, খুনের মামলার আসামি রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মতিউর রহমান। আর রবিউলের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আবু ইউসুফের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর গ্রাম। তার বাবা নুরুজ্জামান, মা হালিমা বেগম।
ডিবি পুলিশ সূত্র জানায়, নিজেকে বাঁচাতে প্রতারণার মাধ্যমে আবু ইউসুফ নামের আরেক যুবককে রবিউল সাজিয়ে আদালতে আত্নসমর্পণ করানো হয়। রবিউলের নাম–ঠিকানা ব্যবহার করে আবু ইউসুফ ২০২০ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাকে জেলে পাঠান৷ প্রায় ৯ মাস জেলে থাকার পর সেই তরুণ একপর্যায়ে সত্য প্রকাশ করে দেন।
লেখক: ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।