আন্তর্জাতিক ডেস্ক : তুরস্কে কয়েক বছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মুদ্রার মান এতটা পড়ে গেছে যে মানুষ এখন সোনা বা ডলার কেনায় ঝুঁকে পড়েছেন। তুর্কি মুদ্রা লিরা অকার্যকর হতে বসেছে। এ অবস্থায় তুরস্কের প্রধান শহর ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ড বা বড় বাজারের ভেতরে আবছায়া এক গলিতে মানুষ এখন ডলার ও সোনা কেনাবেচা করছে।
সিএনএন জানায়, তুরস্কে মূল্যস্ফীতির হার এখন আকাশছোঁয়া। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্কের মূল্যস্ফীতির হার ৬৭ শতাংশে উঠেছে। সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার অমিল এতটাই যে অনেকে মনে করছেন, তুরস্কের মূল্যস্ফীতি ১০০ শতাংশে উঠে গেছে। মূল্যস্ফীতির মধ্যে তুরস্ক একসময় নীতি সুদহার হ্রাস করলেও গত এক বছরে বাড়িয়েছে। এক বছর আগে সুদের হার ছিল ৮ দশমিক ৫, গত জানুয়ারি মাসে তা ৪৫ শতাংশে উঠে গেছে।
সুদহার এত বৃদ্ধির পরও সঞ্চয়কারীদের অর্থের মূল্য কমে যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় সঞ্চয় টিকিয়ে রাখতে তুরস্কের মানুষ এখন ইস্তাম্বুলের বড় বাজারে সোনার দোকানে ছুটছেন। গ্র্যান্ড বাজারের সোনা ব্যবসায়ী ওমর তোজদুমান সিএনএনকে এ কথা বলেছেন। সোনা কিনতে মানুষ যে যা পারছে, তা নিয়েই বাজারে আসছে; কেউ হয়তো স্যুটকেসভর্তি নগদ টাকা নিয়ে আসছে, কেউ আবার পকেটে করে যা পারছে, তা–ই নিয়ে আসছে।
ওমর তোজদুমান আরও বলেন, একসময় মানুষ বাড়ি ও জমি কিনত। এখন সুদহার এত বেশি যে মানুষ হয় ব্যাংকে টাকা রাখছে, না হয় সোনা কিনছে। অনেকে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করছেন। ফলে চলতি বছর জাপানের স্টক মার্কেটের পর সবচেয়ে বেশি সূচক বেড়েছে তুরস্কের স্টক মার্কেটের।
ইস্তাম্বুল শহরের রাস্তাঘাট এখন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের বুথ ও স্বর্ণ বিক্রেতা দিয়ে ভরে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় প্রায় প্রতিটি ব্লকে এদের অস্তিত্ব দেখা যায়। যাঁদের হাতে এখন ডলার আছে, তাঁদের এখন পোয়াবারো। ইস্তাম্বুলের অনেক মুদ্রা বিনিময়কারী এখন আনুষ্ঠানিক দরের চেয়ে বেশি দরে ডলার কিনছেন। চাহিদা এত বেশি যে এতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে না; কারণ তার চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না।
এক মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠানে মালিক আহমেত বাসারান কোলে সিএনএনকে বলেন, যখন লিরা না কিনলেই নয়, মানুষ কেবল তখনই লিরা কেনে। বিষয়টি তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেন, ‘মানুষকে যখন লিরায় কেনাকাটা করতে হয়, তখনই তাঁরা লিরা কিনছেন। কিন্তু বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের জন্য মানুষ মূলত ডলার কিনছেন।’
বিষয়টি নির্ভর করছে মানুষের আদৌ সঞ্চয় আছে কি না, তার ওপর। ইস্তাম্বুলের এশীয় অংশের প্রাক্-স্কুলশিক্ষক মেলেক আলকেসকে সিএনএন জিজ্ঞাসা করে, তিনি কোন মুদ্রায় সঞ্চয় করেন। প্রশ্ন শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন তিনি। বলেন, ‘কিছু রাখতে পারি না; আমার কোনো সঞ্চয় নেই।’ গত এক বছরে তাঁর বেতন কিছুটা বেড়েছে; কিন্তু সেটা মোটেও মূল্যস্ফীতির হারের কাছাকাছি নয়। এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তিনি ক্রেডিট কার্ডনির্ভর হয়ে পড়েছেন। ব্যয় মেটাতে এখন তাঁকে আরেকটি কাজ খুঁজতে হচ্ছে।
মেলেক আলকেস এখন যা বেতন পান, তা ক্রেডিট কার্ডের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হয়ে যায়। এরপর সেই ক্রেডিট কার্ড দিয়েই মাসের বাকি কেনাকাটা সারেন তিনি। তাঁর মা ও বোন উভয়েই এখন পেনশনের ওপর নির্ভরশীল; তাঁরাও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ইস্তাম্বুলের শৌখিন ফুটবল খেলোয়াড় ইরহান ইয়েইগুলেরও একই অবস্থা; এক অফিসে কাজও করেন তিনি। পোশাক–আশাকে কেতাদুরস্ত হলেও পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনিও। ইতিমধ্যে ক্রেডিট কার্ডের ফাঁদে পড়েছে তাঁর পরিবার।
ইরহান ইয়েইগুল বলেন, ‘আপনি বলতে পারেন, আমার বয়স কম, কাজ করতে পারি। হ্যাঁ, কাজ আমি করি, দুটি চাকরি আছে আমার, তারপরও জীবিকা অর্জন করতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফুটবল খেলে যা আয় হয়, তা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনি, এভাবে ফ্রিজ ভরানোর চেষ্টা করছি।’
২০২১ সাল থেকেই তুরস্কে উচ্চ মূল্যস্ফীতি শুরু হয়। কিন্তু তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নীতি সুদহার বৃদ্ধি না করে উল্টো সুদহার হ্রাস করেন। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, আগামী আরও ছয় মাস তুরস্কের মানুষকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। উচ্চ সুদহারের প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগবে। এরপর পরিস্থিতি সহনীয় হতে শুরু করবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।