নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন অতিক্রমের পর ভালোই ছুটছিল ট্রেনটি। ৩০-৪০ মিনিট এভাবে চলার পর হঠাৎ গতি কমতে শুরু করল। কৌতূহলী যাত্রীরা জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। এত দ্রুত তো বঙ্গবন্ধু সেতুর কাছে চলে আসার কথা না! তাহলে কি কিছু হলো? এসব চিন্তার মধ্যেই ট্রেনটি দাঁড়িয়ে গেল নয়নাভিরাম একটি স্টেশনের ৩ নম্বর লাইনে। ঝকঝকে তকতকে স্টেশনটা যেন জনশূন্য ‘মহাশ্মশান’। নেই কোনো যাত্রী, নেই স্টেশনের চিরচেনা কোলাহল। কে যেন বলে উঠল, ‘ক্রসিং পড়ছে।’ কারও কারও মুখ থেকে বেরিয়ে এল বিরক্তির সুর।
দিনটি গত বুধবার। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলওয়ে স্টেশনে বিনা নোটিশে থেমে যাওয়া ঢাকা থেকে লালমনিরহাটগামী বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের কয়েকজন যাত্রী নামল অকারণেই। এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে অজানা-অনাগত ট্রেনকে খুঁজতে লাগল। কিছু সময় পর বিপরীত দিক থেকে এসে ঢুকল একটি লোকাল ট্রেন। আর তাতেই প্রাণ সঞ্চার হলো স্টেশনটিতে।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলওয়ে স্টেশনটি পড়েছে কালিয়াকৈরের চন্দ্রা থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে মাকিশবাথান এলাকায়। গাজীপুরের মৌচাক ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর রেলস্টেশনের মাঝে এর অবস্থান। স্টেশনের পূর্ব দিকে অল্প কিছু দূরেই বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগে সড়কপথের ভোগান্তি কমাতে ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর এটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। এই পথে প্রতিদিন যাতায়াত করে ২০ জোড়া ট্রেন। এই স্টেশনে চাঞ্চল্য বাড়ায় কেবল দুটি লোকাল ট্রেন—সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ও টাঙ্গাইল কমিউটার। এর মধ্যে টাঙ্গাইল কমিউটার সম্প্রতি দুর্ঘটনায় পড়ায় এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ আছে। ক্রসিংয়ের গ্যাঁড়াকলে পড়তে না হলে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস বাদে বাকি ট্রেনগুলো ঝড় তুলে অতিক্রম করে যায় এই স্টেশন।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলওয়ে স্টেশনে ডুয়েলগেজ তিনটি রেললাইন আছে। এর একটি লুপ লাইন। কমলাপুর রেলস্টেশনের আদলে নির্মিত স্টেশন ভবন যে কারও নজর কাড়বে। আছে আধুনিক ইন্টারলকিং সিগন্যালিং সিস্টেম, প্রশস্ত প্ল্যাটফর্ম, উন্মুক্ত বসার জায়গা, বিলাসবহুল বিশ্রামাগার, আধুনিক টিকিট কাউন্টার, শৌচাগারসহ সব। শুধু নেই যাত্রী, নেই স্টেশনের চিরচেনা কোলাহল।
স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাকশিল্পের কর্মীদের বড় অংশই উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার বাসিন্দা। রাজধানীর হেমায়েতপুর, সাভার, নবীনগর, ধামরাই, কালামপুর, নবীনগর, পল্লী বিদ্যুৎ, বাইপাইল (পশ্চিম আশুলিয়া), রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড), জিরানি, কবিরপুর, গাজীপুরের টঙ্গী থেকে শুরু করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুই পাশের ভোগড়া, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, শফিপুর, চন্দ্রা এলাকায় লাখো শ্রমিকের বসবাস। তাঁদের যাতায়াতের একমাত্র পথ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। আর এই পথে চন্দ্রা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি স্টেশনে দেখা যায়, কালিয়াকৈর বাজারের ব্যবসায়ী কবির হোসেন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন। জয়দেবপুর যাবেন তিনি। আক্ষেপ করে বললেন, ‘এত বড় স্টেশন, অথচ ট্রেন থামে না। যদি আরও ট্রেন থামত, তাহলে কালিয়াকৈরবাসীর অনেক উপকার হতো। মহাসড়কের যানজটের ভোগান্তি এড়িয়ে আমরা দ্রুত যাতায়াত করতে পারতাম।’
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন খান জানালেন, তিনি সকাল সোয়া ৯টায় স্টেশনে এসেছেন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা যাবেন বলে। ১০টা ৪০ মিনিটেও ট্রেন আসেনি। তাঁরও অভিযোগ, স্টেশনে সব আছে, শুধু ট্রেন নেই।
বেলা পৌনে ১১টার দিকে সুনসান স্টেশনে হঠাৎ চাঞ্চল্য শুরু হয়। অর্ধশতাধিক যাত্রী এসে হাজির। কোত্থেকে শসা, পানি, চিপসের পসরা নিয়ে কয়েকজন হকারও হাজির। জানা গেল, অবশেষে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন আসছে। টাঙ্গাইলের পর ট্রেনটি সিঙ্গেল লাইনে ঢুকে পড়ায় যাত্রাবিরতি করেছে বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেন। কিছুক্ষণের মধ্যে হেলেদুলে স্টেশনের ১ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়াল সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। ৭০-৮০ যাত্রী নামল। উঠলও বেশ কয়েকজন।
ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের একজনের সঙ্গে চলতে চলতে কথা হলো। পরিপাটি পোশাকের সেই ব্যক্তির নাম মাহফুজ, বাড়ি সিরাজগঞ্জ। চন্দ্রায় একটি কারখানার ব্যবস্থাপক তিনি। জানালেন, সড়কপথের ভোগান্তি থেকে বাঁচতে ট্রেনে চেপে বসেছিলেন। তাঁরও আক্ষেপ, হাইটেক সিটি স্টেশনে আরও কয়েকটা ট্রেন দাঁড়ালে মানুষ উপকৃত হতো, বিপুল টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্টেশনটিও পুরোপুরি কাজে আসত।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি স্টেশনের মাস্টার মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, বিশাল এই স্টেশনে স্টপেজ মাত্র দুটি লোকাল ট্রেনের। এর মধ্যে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেন বন্ধ আছে। দুই ট্রেনের জন্য বরাদ্দ টিকিটের সংখ্যা ৬০টি। স্টেশনের মাসিক খরচ ৫ লাখ টাকার কাছাকাছি। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আয় হয় মাত্র কয়েক হাজার টাকা। ট্রেনের সংখ্যা বাড়ালে আরও বেশি আয় করা সম্ভব ছিল।
এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘চন্দ্রা যোগাযোগব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকা। মহাসড়কের যানবাহন ও যাত্রীর চাপ কমাতে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি স্টেশনে ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাড়ানো উচিত। আমি আশা করি, রেল কর্তৃপক্ষ সবকিছু বিবেচনা করে এই স্টেশনে ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা করবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।