বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর এক টুকরো নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে স্বর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শুল্ক যুদ্ধের অনিশ্চয়তা এবং মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ক্রমাগতই স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুবাইসহ বিশ্ববাজারে রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে দাম। স্বর্ণের দাম বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে স্বর্ণের দাম আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
Table of Contents
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে স্বর্ণের দাম নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুবাইয়ে প্রতি গ্রামে দাম পৌঁছেছিল ৪২০ দিরহাম এবং বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স ৩৫০০ মার্কিন ডলার। যদিও ছুটির দিনে কিছুটা মুনাফা গ্রহণের কারণে সামান্য পতন হয়েছে, তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি সাময়িক।
বিশেষজ্ঞ লিন ট্রান জানান, চীনের বোয়িং অর্ডার বাতিল এবং কৌশলগত পুনর্মূল্যায়ন বাজারে ভীতি ছড়িয়েছে। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আলোচনার অগ্রগতির কথা বললেও, চীনের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছে। এই দ্বন্দ্বময় পরিবেশ স্বর্ণকে পরিণত করেছে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে।
এছাড়াও, বিশ্ববাজারের প্রভাব এখন এতটাই গভীর যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমানোর চিন্তাভাবনা করছে। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি কমলে এবং সুদের হার কমালে স্বর্ণের প্রতি বিনিয়োগের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল ইঙ্গিত দিয়েছেন যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুর্বলতার কারণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। ফলে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে স্বর্ণ কিনতে ঝুঁকছেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে স্বর্ণের দামে।
পেপারস্টোনের গবেষণা কৌশলবিদ আহমদ আসসিরির মতে, যুক্তরাষ্ট্রে আগামী বছরের মধ্যে মন্দার সম্ভাবনা ৫২ শতাংশ। এমন অনিশ্চিত সময়ে স্বর্ণ বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ধরনের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ৩২৪৫ থেকে ৩৩০০ ডলারের মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা স্তর। এই স্তর অতিক্রম করলে দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এদিকে, মার্কিন ইক্যুইটি বাজার যদি শক্তিশালী থাকে এবং ডলারের মান বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্বর্ণের উপর কিছুটা চাপ পড়তে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি, স্বর্ণের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতার সময় মানুষ সাধারণত নিরাপদ বিনিয়োগের সন্ধানে থাকে, আর স্বর্ণ বরাবরই সেই নির্ভরযোগ্য বিকল্প।
কেন স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে?
বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক অর্থনৈতিক ইঙ্গিতই স্বর্ণের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে বলে নির্দেশ করছে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের কোনো দ্রুত সমাধান দৃশ্যমান নয়। বরং উভয় পক্ষের মধ্যে আরও কঠোর অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে।
চীনের প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ এবং মার্কিন প্রশাসনের কড়া মনোভাব বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এমন অবস্থায় ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার থেকে সরে এসে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাতে পারে — যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মার্কিন ডলারের ওপর। ডলার দুর্বল হলে স্বর্ণের দাম বাড়ার প্রবণতা থাকে। কারণ ডলার দুর্বল হলে স্বর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারে তুলনামূলক সস্তা হয়ে পড়ে, ফলে চাহিদা বাড়ে।
তৃতীয়ত, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক উত্তেজনাও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন, দক্ষিণ চীন সাগরসহ নানা অঞ্চলে সৃষ্ট উত্তেজনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ফলে তারা স্বর্ণকে নিরাপদ স্থাবর সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছে।
চতুর্থত, প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ৩৩০০ ডলারের স্তর ভেঙে যায়, তবে খুব দ্রুতই ৩৪৫০ থেকে ৩৫০০ ডলারে পৌঁছানো সম্ভব।
একইসঙ্গে, স্বর্ণের সরবরাহ সংকটও একটি বড় ভূমিকা রাখছে। মাইনিং খরচ, পরিবেশগত নীতিমালা, এবং নতুন খনির সন্ধান কমে যাওয়ায় স্বর্ণের প্রাপ্যতা সীমিত হচ্ছে। ফলে দাম স্বাভাবিকভাবেই ঊর্ধ্বমুখী।
Wikipedia অনুসারে, স্বর্ণ একটি বহুমূল্য ধাতু যা ইতিহাস জুড়ে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে আসছে (source).
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চলমান ট্রেন্ড এবং বিশ্লেষণ
বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং স্বর্ণের কৌশলগত মূল্য
বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, আগামী এক বছরে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে শেয়ার বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে এবং বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে স্বর্ণকে বেছে নেবে। অতীতের ইতিহাসও এই প্রবণতাকে সমর্থন করে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় স্বর্ণের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
ফেডারেল রিজার্ভের ভূমিকা এবং সুদের হার
বর্তমানে ফেডারেল রিজার্ভের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করছে যে, মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে এবং অর্থনীতির গতি বাড়াতে সুদের হার কমানোর প্রবণতা দেখা দিতে পারে। কম সুদের হার সাধারণত স্বর্ণের বিনিয়োগকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে, কারণ তখন অন্যান্য স্থায়ী আয়ের বিনিয়োগ কম লাভজনক হয়ে ওঠে।
চীন-মার্কিন সম্পর্ক ও স্বর্ণের বাজার
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। চীনের প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতিমালা স্পষ্ট করছে, এই সংঘাত আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এর ফলে স্বর্ণের উপর আস্থা বেড়ে যাচ্ছে।
FAQs: স্বর্ণের দাম সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
১. বর্তমানে স্বর্ণের দাম এত বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ কী?
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা মূল কারণ।
২. স্বর্ণের দাম কি আরও বাড়বে?
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান ট্রেন্ড অব্যাহত থাকলে স্বর্ণের দাম ৩৪৫০ থেকে ৩৫০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে।
৩. এখন স্বর্ণে বিনিয়োগ করা কি নিরাপদ?
বর্তমানে অস্থির অর্থনৈতিক পরিবেশে স্বর্ণ একটি নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
৪. ডলারের মান বৃদ্ধি পেলে স্বর্ণের দামে কী প্রভাব পড়বে?
ডলারের মান বৃদ্ধি পেলে স্বর্ণের দাম কিছুটা চাপে পড়তে পারে, তবে সামগ্রিক অনিশ্চয়তা স্বর্ণের চাহিদা স্থিতিশীল রাখবে।
৫. মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সংকট স্বর্ণের দামে কতটা প্রভাব ফেলছে?
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক উত্তেজনা সরাসরি স্বর্ণের চাহিদা বাড়িয়ে দিচ্ছে, যার ফলে দাম বাড়ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।