সম্প্রতি প্রায়ই স্মার্টফোন বিস্ফোরণ ঘটার খবর সামনে আসছে। কিছুদিন আগেই OnePlus ব্র্যান্ডের Nord2 মডেলের বিস্ফোরণের রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়াও Samasung ব্র্যান্ডের Galaxy ডিভাইসগুলির বিভিন্ন সময় ব্লাস্ট করে যাওয়ার ঘটনাও বেরিয়ে এসেছে। যাদের সাথে এই ধরণের ঘটনা ঘটেনি তাদের কাছে এমন দুর্ঘটনা খুব সাধারণ মনে হলেও, এমন বিপজ্জনক ইনসিডেন্টের ফলে ইউজারের লাইফে রিস্কও থাকে।
বেশিরভাগ মোবাইল কোম্পানিগুলো এই ধরনের ঘটনার জন্য ইউজারদের ভুল ব্যবহারের দিকে আঙ্গুল তুলে এড়িয়ে যায়। তবে সবসময় কিন্তু এমনটা হয় না। অনেক সময় কিন্ত ফোন মেকিং প্রসেসেও ভুল- ত্রুটি থাকে, যার ফল ভোগ করতে হয় গ্রাহকদের।
আজ আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি এমন একটি প্রতিবেদন যেখানে আপনি জানতে পারবেন যে ঠিক কি কি কারণে স্মার্টফোন বিস্ফোরণ হয়। যা আপনাকে আরও একটু বেশি সচেতন থাকতে সাহায্য করবে।
যে কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত স্মার্টফোন বিস্ফোরণ ঘটে
১। উৎপাদন ত্রুটি :
ফোন বিস্ফোরিত হওয়ার প্রধান কারণ হলো উৎপাদন ত্রুটি। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি যা হ্যান্ডসেটকে শক্তি জোগায়। তা বাজারজাতকরণের আগে সঠিকভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। একটি ভুল উপাদান বা অ্যাসেম্বলি লাইনের ত্রুটির ফলে ব্যাটারি ত্রুটিযুক্ত হতে পারে। ব্যাটারির ভেতরের কোষগুলো এরকম নানা কারণে মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রায় পৌঁছায় (বাহ্যিক তাপ, অতিরিক্ত চার্জিং বা দুর্বল উৎপাদনের কারণে)। সস্তা ব্যাটারিতে শর্টসার্কিট হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
২। নকল চার্জার ব্যবহার:
ফাস্ট চার্জিং অ্যাডাপ্টার ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকতে হবে। স্মার্টফোনের সঙ্গে যে চার্জারটি দেওয়া হয়, ফোন চার্জ করার ক্ষেত্রে সব সময় সেটিই ব্যবহার করা ভালো। উচ্চক্ষমতার অন্য চার্জার ব্যবহার করলে ফোনের ব্যাটারির ওপর চাপ পড়ে ফোনে আগুন ধরে যেতে পারে। এ ছাড়া নকল চার্জারের ব্যবহার ফোনের ব্যাটারির ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে।
৩। থার্ড পার্টি চার্জারের ব্যবহার :
অধিকাংশ মানুষ যে সাধারণ ভুলটি করে থাকে তা হলো, নিজস্ব চার্জার ছাড়া অন্য ফোনের চার্জার দিয়ে চার্জ করা। দেখতে একই রকম হলেও থার্ড-পার্টি চার্জারে হ্যান্ডসেটের জন্য প্রয়োজনীয় ফিচার থাকে না।
৪। অতিরিক্ত চার্জ/রাত্রিকালীন চার্জিং :
ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হওয়ার প্রধান কারণ রাত্রিকালীন চার্জিং। ঘুমাতে যাওয়ার সময় ফোন চার্জিংয়ে রাখার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এটি ব্যাটারির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত চার্জ মাত্রাতিরিক্ত গরম, শর্টসার্কিট এবং বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। বর্তমানে অনেক স্মার্টফোনে এমন একটি চিপ থাকে, যা ব্যাটারির স্তর ১০০ শতাংশ হলে বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। বাজারে এখনো সাশ্রয়ী মূল্যের কিছু হ্যান্ডসেট রয়েছে যাতে এ ফিচারটি নেই।
৫। প্রসেসরের মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা :
স্বাভাবিকভাবেই প্রসেসর ফোনকে গরম করতে ভূমিকা রাখে। চিপসেট এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী, মাল্টি-টাস্কিং এবং পাবজির মতো ভারি গ্রাফিক্সের অ্যাপ চালানোর তাপজনিত সমস্যা রয়েছে। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওএম স্মার্টফোনগুলোতে থার্মাল লক বা থার্মাল পেস্ট বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, থার্মাল লক ফেইল হয় এবং ফোনের বিস্ফোরণ ঘটে।
৬। কার চার্জিং অ্যাডাপ্টার ব্যবহার:
ভ্রমণকালে ফোন চার্জ করার জন্য অনেকে পাওয়ার ব্যাংকের বদলে কার চার্জিং অ্যাডাপ্টার ব্যবহার নিরাপদ মনে করেন। অনেক সময় গাড়িতে থার্ড-পার্টি বিক্রেতাদের কাছ থেকে অ্যাক্সেসরিজ ইনস্টল করে থাকেন এবং ওয়্যারিংয়ের দিকে তারা সেভাবে নজর দেন না। এ কারণে আচমকা পাওয়ার ফ্লাকচুয়েশন থেকে অনেক সময় ব্যবহূত স্মার্টফোনটি বিস্ম্ফোরিত হতে পারে।
৭। পাওয়ার স্ট্রিপ বা এক্সটেনশন কর্ড:
ফোন চার্জ করার সময় পাওয়ার স্ট্রিপ বা এক্সটেনশন কর্ড ব্যবহার করলে শর্টসার্কিটের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ফলে আগুন লাগা থেকে শুরু করে বিস্ম্ফোরণের মতো অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ জন্য সরাসরি দেয়ালের সকেটে স্মার্টফোন চার্জ করতে হবে।
৮। ব্যাটারি:
বিভিন্ন কারণে স্মার্টফোনে ব্যাটারি পরিবর্তনের দরকার পড়ে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কোনো অবস্থায় আমাদের থার্ড-পার্টি কিংবা নকল ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে না। বিশেষত ফোনে ব্যবহূত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে যদি নির্মাণজনিত কোনো ত্রুটি থাকে তাহলে তা অতিরিক্ত গরম হতে পারে। যার ফলে আগুন ধরার পাশাপাশি বিস্ম্ফোরণের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৯। সরাসরি সূর্যালোকে ফোন রাখা :
অতিরিক্ত তাপ ফোনের ব্যাটারি নষ্ট করে দিতে পারে। এতে কোষ কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায়, এক্সোথার্মিক ভেঙে যায়, যা অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্যাস উৎপন্ন করে। এসব গ্যাসের কারণে ব্যাটারি ফুলে যায়, এর গঠন বিকৃত হয় এবং শেষ পর্যন্ত ফোন বিস্ফোরিত হতে পারে।
১০। ফোন ক্ষতিগ্রস্ত হলে:
অসাবধানতায় হাত কিংবা পকেট থেকে স্মার্টফোনটি পড়ে যেতে পারে। হ্যান্ডসেট পড়ে যাওয়ার পর স্ট্ক্রিন যদি বেশ কয়েক জায়গা ফেটে যায় কিংবা ফোন খুলে কয়েক খণ্ড হয়ে যায় তবে সেটি নিজে চালু না করে নিকটস্থ সার্ভিস সেন্টারে নেওয়া ভালো।
১১। স্থানীয় দোকানে সার্ভিসিং:
স্মার্টফোনে কোনো সমস্যা হলে সেটিকে মেরামত করার জন্য লোকাল রিপেয়ারিং শপের শরণাপন্ন হওয়া উচিত নয়। শুধু অনুমোদিত সার্ভিস সেন্টারগুলো থেকে স্মার্টফোন মেরামত করা উচিত।
স্মার্টফোন বিস্ফোরিত হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে এগুলো অন্যতম। যদিও স্মার্টফোনের বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুন খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়। তবুও সতর্ক থাকা উচিত।
স্মার্টফোন বিস্ফোরণ এড়াতে করণীয়
স্মার্টফোনের ব্যাটারি ক্ষতিগ্রস্ত এবং এটি বিস্ফোরিত হতে পারে এমনটি বোঝার যেসব সাধারণ সতর্কতামূলক লক্ষণগুলো খেয়াল করুন। ব্যাটারির ফোলাভাব, হিস শব্দ বা পপিং করছে কিনা নজর দিন। এ ছাড়া নিশ্চিত করুন যে আপনি ফোনের নিজস্ব চার্জার ব্যবহার করছেন, অতিরিক্ত চার্জিং করছেন না এবং ফোনকে জল থেকে দূরে রাখছেন (বিশেষ করে যদি এটি জল-প্রতিরোধী না হয়)। প্রচণ্ড গরম হলে ফোন চার্জ করবেন না এবং চার্জ করার সময় বালিশের নিচে বা মাথার কাছে না রেখে অন্য কোথাও রাখুন।
বিপদ এড়াতে নিচের তথ্যগুলো মনে রাখবেন
১. প্রকৃত কেবল বা অ্যাডাপটার ছাড়া থার্ড পার্টির চার্জিং কেবল বা অ্যাডাপটার ব্যবহার করবেন না। আসল চার্জার নিরাপদ। স্মার্টফোন কেনার সময় প্রকৃত চার্জার বা অ্যাডাপ্টার দেওয়া হচ্ছে কি না, তা দেখে কিনবেন। ওয়ারেন্টির বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নেবেন।
২. আপনার ডিভাইসের যদি ব্যাটারি পরিবর্তন করতে হয়, তবে যে প্রতিষ্ঠানের ডিভাইস, তাদের তৈরি ব্যাটারি কিনুন। তা না হলে ব্যাটারি কিছুদিন পরে ঠিকমতো কাজ করবে না।
৩. স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিযুক্ত ডিভাইসে অতিরিক্ত চার্জ দেবেন না। জার্মান ব্যাটারি প্রযুক্তি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ব্যাটারি ইঞ্জিনিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডমিনিক শুলঠে বলেন, যদি ফোনে শতভাগ চার্জ দেন এবং দীর্ঘক্ষণ শতভাগ চার্জ ধরে রাখেন, তা ব্যাটারির আয়ুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। স্মার্টফোনের ব্যাটারির চার্জ ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ থাকলে তার আয়ু থাকে বেশি দিন।
৪. দাহ্য পৃষ্ঠের আসবাব, বিছানা, কাগজের কাছাকাছি ডিভাইস রেখে চার্জ দেবেন না। অনেক সময় অতিরিক্ত গরম হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
৫. ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে স্মার্টফোন রেখে চার্জ দেবেন না।
৬. সরাসরি সূর্যের আলোতে বেশিক্ষণ স্মার্টফোন বা ডিভাইস রাখবেন না।
৭. স্মার্টফোন বা ডিভাইস সারাতে অননুমোদিত কোনো দোকানে যাবেন না। এতে যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। অথরাইজড সেন্টার থেকে সেবা নিন।
৮. চার্জে থাকা অবস্থায় ডিভাইসের ওপর যাতে বাড়তি চাপ না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
৯. স্মার্টফোন বা ডিভাইস চার্জ দেওয়ার সময় পারলে এর কেস খুলে নিন।
১০. ফোন চার্জের সময় ইয়ারফোন ব্যবহার বা ফোনে কথা বলার সময় চার্জ দেবেন না।
১১. অনেকে সস্তা খোলা বাজারের পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহার করেন। পাওয়ার ব্যাংক মোবাইলের ব্যাটারি নষ্ট করে দিতে পারে। ঘটাতে পারে বিস্ফোরণ।
১২. মোবাইল ব্যবহার করতে করতে ব্যাটারি একটু ফুলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটারি চেঞ্জ করা দরকার।
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel