মোঃ মাহামুদুল হাসান : ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন একটি বাস্তবতা। পরবর্তী লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বলতে স্মার্ট নাগরিক, সমাজ, অর্থনীতি ও স্মার্ট সরকার গড়ে তোলা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর। এ জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং এর উন্নয়নে একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন করতে হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পাওয়ার পর একে আরো এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পতিত হওয়া আওয়ামী সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও বিশ্বের কাছে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর বিকল্প নেই। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এবং পরবর্তীতে যে সরকারই আসুক না কেন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ধারণাটি বাস্তবায়ন করতে পারলে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ-এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি স্তম্ভের প্রথমটিই হচ্ছে স্মার্ট নাগরিক। একটি মানবশিশু পরিবারের গন্ডির বাইরে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য স্মার্ট নাগরিক গড়ে তুলতে হবে যার কেন্দ্রবিন্দু হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্মার্ট অবকাঠামো, স্মার্ট কারিকুলাম, স্মার্ট শিক্ষক ও স্মার্ট শিক্ষক প্রশিক্ষণ, স্মার্ট শিখন-শেখানো কার্যক্রম, স্মার্ট পরিবেশ এগুলোর মাধ্যমেই তৈরী হবে স্মার্ট নাগরিক। প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে সমস্যা সমাধানে প্রস্তুত এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিক হবেন তারা।
সরকারের ডিজিটাল কর্মপরিকল্পনার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা। ইন্টারনেট সংযোগের নানামুখী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট ও ওয়াইফাই সংযোগ। প্রায় প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট/ওয়াইফাই সংযোগের পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, সরবরাহ করা হয়েছে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, স্মার্ট বোর্ড এবং ইন্টারএকটিভ ফ্লাট প্যানেল। আকর্যণীয় প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণীকক্ষ তৈরীসহ ২ বছর মেয়াদী প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করা হয়েছে। গতানুগতিক শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক আনন্দময় শিক্ষায় রুপান্তর করা হয়েছে।
শিক্ষকগণকে দক্ষ, যোগ্য ও চাহিদা ভিত্তিক মেন্টর, লিডার ও গাইড হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রশিক্ষণকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। ডিপিএড এর পরিবর্তে প্রশিক্ষণ মোডে চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ১০ মাস মেয়াদী সম্পূর্ণ পরিমার্জিত মৌলিক প্রশিক্ষণ (BTPT) কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুটিও যেন উদ্ভাবনী মানষিকতা সম্পন্ন হয় এবং নিজের মধ্যে অন্তর্নিহিত প্রতিভাকে যেন বিকশিত করার সুযোগ পায় এবং মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন নাগরিক হয় সেজন্য শিখন-শেখানো পদ্ধতিকে করা হয়েছে কার্যকর ও যুগোপযোগী। শিক্ষকগণের নিজেদের মধ্যে নলেজ শেয়ারিং এর জন্য শিক্ষক বাতায়নের যে প্লাটফর্মটি তৈরী করা হয়েছে তা অভাবনীয় ভূমিকা রাখছে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিখন-শেখানো কার্যক্রম গ্রহণ আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; বরং ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
করোনা মহামারীকালে সমগ্রবিশ্ব যখন স্থবির তখনো ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আমাদের শিশুদের কলকাকলিতে মুখর ছিল অনলাইন শিক্ষাঙ্গন। প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ “ঘরে বসে শিখি” এবং “অনলাইন স্কুল” পরিচালনাসহ দূর-শিক্ষনের নূতন ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় আরো একধাপ এগিয়ে দুর্যোগকালীন সময়ে মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং শিক্ষকগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। একীভূত শিক্ষা নিশ্চিত করা, প্রতিবন্ধী বাচ্চাদেরকে মুল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষকগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়কে আনা হচ্ছে স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থায়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দেশের সামগ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমের একটি সমন্বিত প্লাটফর্ম ‘ওয়ান স্মার্ট প্লাটফর্ম; অল ডিজিটাল সার্ভিস’ বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তৈরী করা হয়েছে Integrated Primary Education Management Information System বা IPEMIS ।
প্রতি বছর ১ জানুয়ারি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই প্রদান, উপবৃত্তি প্রদান, স্কুল মিল কর্মসূচি চালু, স্মার্ট ক্লাস রুম ও স্মার্ট শিখন-শেখানো কার্যক্রম চালু, আকর্ষণীয় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার কারণে ঝড়ে পড়া হ্রাসসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেট ও গ্রস এনরোলমেন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
উন্নত বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে, ডিজিটাল লার্নিং মেটারিয়েল প্রদান, শিশুদেরকে আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্বনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য কাব-স্কাউটিং কার্যক্রম সম্প্রসারণের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণে কাব-স্কাউটিং বেসিক কোর্সকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যাতে করে সকল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে কাব-স্কাউটিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত/ধারণাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিখন-সহায়ক সামগ্রি প্রদান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘ফিউচার ল্যাব’ স্থাপন, শিক্ষক নির্দেশিকা প্রদান, ডিজিটাল লার্নিং মেটেরিয়াল প্রদানসহ কার্যকর ধারাবাহিক মূল্যায়নের লক্ষ্যে অ্যাপস তৈরীর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যা সামনের দিনগুলোতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সরকারি প্রাথমিক স্কুল হতে খেলোয়ার, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী তৈরি করা হচ্ছে। প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে ক্ষুদে ডাক্তার কর্মসূচি, পুষ্টি কর্ণার স্থাপন, সততা স্টোর, প্লেয়িং কর্ণার, ডিজিটাল ল্যাব, স্মার্ট শ্রেণী কক্ষ তৈরি কার্যক্রমগুলো আগামী দিনে স্মার্ট সিটিজেন তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রতিটি বিদ্যালয়ের সামগ্রিক তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল মনিটরিংয়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা সামনের দিনগুলোতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে আকর্ষণীয় স্কুল ভবন, স্কুল প্রাঙ্গণ, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ, দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক, শিখন-শিখানো কার্যক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রূপান্তরিক ও যুগোপযোগী কারিকুলাম কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে যেমন স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট করছে; তেমনি তাদের জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুন। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি উপকরণ যেন হয় শিক্ষার উপকরণ এমন ভাবনা থেকে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষকগণকে স্মার্ট করে তোলা, স্মার্ট শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা, শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে স্মার্ট করাসহ এ সকল কর্মসূচির উদ্যেশ্যই হচ্ছে সময়োপেযোগী দক্ষ, যোগ্য, প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন ও মানবিক গুণসম্পন্ন দেশপ্রেমিক স্মার্ট নাগরিক সৃষ্টি। আর স্মার্ট নাগরিক তৈরির আঁতুড়ঘর হিসেবে আবির্ভূত হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।