জুমবাংলা ডেস্ক : এবার বাজারে সয়াবিন তেলের উত্তাপের পর ফের পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ছে। প্রতিকেজিতে ১০ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দু’দিন ধরে ব্যবসায়ীরা ৪০-৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটি। ক্রেতাদের অভিযোগ ব্যবসায়ীদের কারিসাজিতে বেড়েছে এর দাম। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন এলসি বন্ধ হওয়ার কারণে বেড়েছে এর দাম।
নগরীর কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি পেঁয়াজ বর্তমানে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ৪০ থেকে-৫০ টাকা। অথচ গত দু’দিন আগেও এ পণ্যটির দাম ছিল ৩০ টাকা। সরবরাহের ঘাটতির কথা বলে এর দাম বাড়ানো হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
দেশে পেঁয়াজের যত কাণ্ড, তার বেশিরভাগই আমদানির প্রধান উৎস ভারতের বাজারের গতিবিধি ঘিরে। এবারও ব্যতিক্রম নয়, গত ৫ মে ভারত থেকে আমদানি বন্ধের ছুতায় পেঁয়াজের দর ফের পাগলা ঘোড়া। এই দাম কোথায় গিয়ে থামবে, সেটার আগাম বার্তা না থাকায় পেঁয়াজ কিনতে বাজারে হুমড়ি খাচ্ছেন একশ্রেণির ক্রেতা।
তবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পেঁয়াজ আমদানির দাবি এসেছে। আমদানির বিষয়টি এখনই আমাদের ভাবনায় নেই। কয়েক দিন পর তা আমরা দেখব। অনেকেই বলে থাকেন, কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না, তাদেরও তো কিছু দাম পেতে হবে।
কয়েক বছর ধরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে অস্থির থাকে পেঁয়াজের বাজার। এবার একটু আগেভাগেই চোখ রাঙাচ্ছে পণ্যটি। দু’দিনের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে কেজিতে পেঁয়াজের দর বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কারওয়ান বাজারে দু’দিন আগে খুচরায় দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। গতকাল বুধবার সেই একই মানের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা চাইছেন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। তবে কারওয়ান বাজারের বাইরের এলাকায় এই দাম আরও বেশি। তেজকুনীপাড়া এলাকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। অথচ ঈদের আগেও একই পেঁয়াজ কেনা যেত ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি।
এদিকে, চট্টগ্রামের বৃহত্তম পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম দু’দিনে বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। সপ্তাহের শুরুতে খাতুনগঞ্জে যে পেঁয়াজের দাম ছিল কেজিতে ২৫ থেকে ২৮ টাকা, গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা। চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকায়।
হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে হুটহাট করে পণ্যের দাম বাড়ে। কিছু ডিলার ও পাইকার যেভাবে তেল মজুত করে সংকট তৈরি করেছিল, ঠিক একই পথে হাঁটছে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। আমদানি বন্ধ হলেও দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়বে কেন? এমন প্রশ্ন তুলছেন ক্রেতারা।
পেঁয়াজের চাহিদা :কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজের চাহিদা ছিল ৩৫ লাখ টন। এই ২০২১-২২ অর্থবছরে চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৯ লাখ ৫৫ হাজার টন। জমি থেকে তোলার সময় নষ্ট হওয়া, নিম্নমান ও পচে যাওয়ার কারণে প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ ফেলে দিতে হয়। ফলে ছয় থেকে সাত লাখ টন আমদানি করা হয়ে থাকে। আমদানি করা পেঁয়াজের ৮ থেকে ১০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণে নষ্ট হয়। দেশে যত পেঁয়াজ আমদানি হয়, তার ৮০ শতাংশের বেশি প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেই আসে।
ক্রেতারা ক্ষুব্ধ :গতকাল রাজধানীর মালিবাগ থেকে কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে এসেছেন গৃহিণী শাহানারা ফেরদৌস। দরকষাকষি করে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন ৪৫ টাকায়। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তিন বছর ধরে পেঁয়াজের দর নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। অকারণে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়। ৩০০ টাকা দিয়েও পেঁয়াজ কিনতে হয়েছে। আমদানি বন্ধ হলে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম বাড়বে কেন? তেলসহ অন্য জিনিসের দাম বাড়ার সুযোগে পেঁয়াজের দামটাও বাড়িয়ে দিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীর দল।
অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিম আরামবাগ থেকে কারওয়ান বাজারে এসেছেন পেঁয়াজ কিনতে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করে দাম বাড়িয়েছে। দু’দিনের ব্যবধানে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা দাম বাড়াটা অস্বাভাবিক। দাম আরও বাড়বে মনে হচ্ছে, তাই একসঙ্গে ৩০ কেজি কিনেছি। এই যে তেলের পর পেঁয়াজের দাম বাড়ল, একের পর এক জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে; সরকারের নজরদারির কারণেই এমন কারসাজির সুযোগ পাচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
তবে বরাবরের মতোই চাহিদা বেড়ে যাওয়া আর আমদানি বন্ধকে খোঁড়া যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের কারণে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ছে। সে কারণে দাম বেড়েছে। তবে অন্য সময়ের মতো খুব বেশি বাড়বে না বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
কারওয়ান বাজার, তেজকুনীপাড়া ও মহাখালী কাঁচা বাজারের কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী বলছেন, আমদানির অনুমতির সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় চার থেকে পাঁচ দিন ধরে পেঁয়াজ বন্ধ রয়েছে। সেই কারণে দেশে দাম বেড়েছে।
ক্রেতাদের হুড়োহুড়ি :দাম বাড়ায় বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ক্রেতারা। গতকাল বুধবার দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ আড়তে ঘুরে দেখা যায়, দোকানদারদের পাশাপাশি বাসাবাড়ির জন্য প্রয়োজনের চেয়েও বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ কিনছেন ক্রেতারা। গত তিন বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বেশি পেঁয়াজ কিনছেন বলে জানান তারা।
পেঁয়াজ ব্যাপারি আনোয়ার এন্টারপ্রাইজের শামছুর রহমান জানান, তারা রাতে ব্যবসা করেন, দিনে ঘুমান। এখন দিনেই ক্রেতার চাপে ঘুমানো যাচ্ছে না। একটু পরপর ক্রেতা আসছেন। এত দিন যিনি পাঁচ কেজি কিনতেন, তিনি নিচ্ছেন এখন ২০ কেজি।
বড় ব্যবসায়ীরা করছেন মজুত :পাবনার সুজানগরের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, এখন বড় পাইকাররা পেঁয়াজ কিনছে বেশি। ফলে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রতিদিন পাইকাররা পেঁয়াজ নিচ্ছে। ফলে গত পাঁচ থেকে ছয় দিনের ব্যবধানে পাবনায় প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আগে পেঁয়াজের মণ ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়।
মন্ত্রণালয়ের চোখ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে :বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করছে, আইপি বন্ধ হওয়ায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের দামে তেমন প্রভাব এখন পড়বে না। দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে, তা দিয়ে চাহিদা মোকাবিলা করা যাবে। তারপরও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সংকট তৈরি হতে পারে বলে ধারণা করছে মন্ত্রণালয়। তখন প্রয়োজন বুঝে আবার আইপি অনুমোদন দেবে তারা। ঈদুল আজহার সময় অতিরিক্ত দুই থেকে তিন লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা থাকে। তারপরও এখন সংকট হবে না বলে ধারণা করছে মন্ত্রণালয়।
পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করলে অভিযান :পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফয়েজ উল্যাহ। তিনি বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি আমাদের নলেজে আছে। সরবরাহ সংকটকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে কেউ যদি অধিক মুনাফা করতে চায়, তাহলে আইনের আওতায় আনা হবে তাকে।’
ক্যাবের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বাজারে আগের কেনা পর্যাপ্ত পেঁয়াজ থাকার পরও দাম হঠাৎ বাড়ার পেছনের কারণ প্রশাসনকেই খুঁজে বের করতে হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।