মক্কা নগরী। মসজিদুল হারামের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আব্দুর রহমানের চোখ জলে ভেসে গেল। চারপাশের লক্ষ-কোটি মুমিনের সমুদ্র, কাবা শরীফের অপরূপ সৌন্দর্য, আর সেই পবিত্র স্থানের নির্মল বাতাস – সবকিছু মিলিয়ে তার হৃদয় ভরে উঠল এক অদম্য প্রশান্তিতে। বছরখানেক আগেও এই দৃশ্য ছিল তার জন্য শুধুই স্বপ্ন, টেলিভিশনের পর্দায় দেখা এক অনন্ত আশা। একজন সাধারণ কুমারটুলির দর্জি হিসেবে তার পক্ষে হজ করা কি আদৌ সম্ভব? বাধা ছিল অর্থের সংস্থান, ছিল জটিল নিয়মকানুনের ভীতি, ছিল দূরদেশের এক অচেনা ভূখণ্ডে যাত্রার অনিশ্চয়তা। কিন্তু আজ, সাদা ইহরামে মোড়া শরীর নিয়ে, যখন তিনি তালবিয়া পাঠ করছেন – “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…” – তখন সব সংশয়, সব ক্লান্তি মুছে গেছে। তার এই পরিবর্তনের চাবিকাঠি? “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” নামে একটি বাংলা গাইডবই, যা তাকে ধাপে ধাপে, ভয় দূর করে, এই মহান ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করেছিল। আব্দুর রহমানের মতো লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশির হৃদয়ে ধ্বনিত হয় এই প্রশ্ন: কিভাবে এই পবিত্র সফরকে শুধু চোখের জলের না, বরং গভীর জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাসের সাথে পালন করা যায়? এই গাইডই সেই উত্তর খোঁজার পথ দেখাবে।
হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড – আপনার যাত্রার প্রস্তুতিপর্ব
“হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” শুরু হয় মনের প্রস্তুতি দিয়ে। কেননা, হজ বা ওমরাহ শুধু শারীরিক সফর নয়; এটি হৃদয় ও আত্মার এক গভীর যাত্রা। বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য প্রথম ধাপ হলো নিয়ত বা ইচ্ছাকে পরিশুদ্ধ করা। এই সফর একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, দুনিয়াবী কোনো কামনা-বাসনা বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। এই মানসিক প্রস্তুতির পাশাপাশি আসে বাস্তব প্রস্তুতি:
- আর্থিক প্রস্তুতি: হজ বা ওমরাহ একটি ব্যয়বহুল ইবাদত। বাংলাদেশ থেকে সরকারি বা বেসরকারি হজ প্যাকেজের খরচ বিবেচনা করে অনেক আগে থেকেই সঞ্চয় শুরু করা অপরিহার্য। সরকারি কোটা, বেসরকারি এজেন্সির বিশ্বস্ততা যাচাই (ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত কিনা দেখুন), এবং প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত সবকিছু (যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, ভিসা ফি, জিয়ারত ইত্যাদি) স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের হজ অফিস (https://hajj.gov.bd/) থেকে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পাওয়া যায়।
- শারীরিক প্রস্তুতি: হজের রীতিনীতি শারীরিকভাবে বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাওয়াফ, সায়ী, আরাফাতের দিনের দীর্ঘ অবস্থান, মিনা-মুজদালিফায় যাতায়াত – এসবের জন্য ভালো স্বাস্থ্য জরুরি। যাত্রার কয়েক মাস আগে থেকেই হাঁটাচলা বাড়ানো, সম্ভব হলে ছোট ছোট সাওয়ারি বা জিয়ারতের জন্য শরীরকে অভ্যস্ত করা এবং অবশ্যই একজন যোগ্য চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে শারীরিক ফিটনেস নিশ্চিত করা উচিত। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদি ক্রনিক রোগ থাকলে বিশেষ সতর্কতা ও প্রস্তুতি নিতে হবে।
- জ্ঞানার্জন: এটাই “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। হজের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল ইবাদতগুলো, বিভিন্ন স্থানের গুরুত্ব, দোয়া-জিকির, এবং কী করা নিষিদ্ধ (মুস্তাহাব্বাত ও মাকরুহাত) – এসব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে ইবাদত ভঙ্গ হওয়ার বা কবুল না হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষায় রচিত নির্ভরযোগ্য গাইডবই, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত বইপত্র, এবং বিশ্বস্ত আলেমদের বক্তব্য শোনা বা প্রশ্ন করা এই জ্ঞানার্জনের প্রধান উৎস। কখনোই শুধু অন্যের দেখাদেখি বা মুখে শোনা কথার উপর নির্ভর করা উচিত নয়। মনে রাখবেন, এই জ্ঞানই আপনার হজ বা ওমরাহকে অর্থপূর্ণ করে তুলবে।
ইহরাম: পবিত্রতার প্রতীক ও আত্মসমর্পণের সূচনা
“হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এর পরবর্তী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ইহরাম। এটি শুধু দুই টুকরো সাদা কাপড় নয়; এটি মুমিনের আত্মিক অবস্থার একটি শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ, দুনিয়াবী সব মোহ ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার প্রতীক। হজ বা ওমরাহর জন্য এটি ফরজ।
- ইহরামের স্থান (মিকাত): ইহরাম বাঁধার জন্য নির্দিষ্ট স্থানকে মিকাত বলে। মক্কা-মদিনার দিকে যাত্রাকালে এই মিকাত অতিক্রম করার আগেই ইহরাম বাঁধতে হয়। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি জেদ্দা বা মদিনায় যাওয়া যাত্রীদের জন্য বিমানেই সাধারণত ইহরাম বাঁধার নির্দেশ দেওয়া হয় (বিমান কোম্পানি আগেই জানিয়ে দেয়)। তবে, সঠিক মিকাত সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। যেমন, মদিনা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে ‘বীরে আলী’ বা ‘আবিয়ার আলী’ মিকাত হিসেবে পরিচিত। মিকাত অতিক্রম করার পর ইহরাম না বাঁধলে দম (কোরবানি) দিতে হবে।
- ইহরামের কাপড়: পুরুষদের জন্য দুটি অসেলাই করা সাদা কাপড় – একটি কোমরে জড়ানোর (ইজার), অন্যটি শরীরের ওপর অংশে জড়ানোর (রিদা)। মহিলাদের জন্য তাদের সাধারণ পোশাকই ইহরাম, তবে অবশ্যই শরীয়তসম্মত পর্দা রক্ষা করে (মুখ ও হাতের তালু ছাড়া শরীর ঢাকা) এবং সেলাই করা পোশাক পরা যায়। কাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া চাই।
ইহরামের নিয়ত ও তালবিয়া: নির্দিষ্ট মিকাতে পৌঁছে গোসল বা ওজু করে পবিত্র হয়ে নির্দিষ্টভাবে হজ বা ওমরাহর নিয়ত করে ইহরামের কাপড় পরিধান করতে হয়। এরপর দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে তালবিয়া পাঠ শুরু করতে হয়:
- لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيْكَ لَكَ
- (লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারীকা লাক)
- অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি তোমার ডাকে সাড়া দিলাম, আমি হাজির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, সকল নেয়ামত এবং সার্বভৌমত্ব তোমারই। তোমার কোন শরীক নেই।” তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করতে হয় এবং হজ বা ওমরাহের বিভিন্ন পর্যায়ে (বিশেষ করে উঠা-বসা, যানবাহনে ওঠা-নামা, সাথীদের সাথে দেখা ইত্যাদি সময়ে) পাঠ করা মুস্তাহাব।
- ইহরাম অবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ (মাহযুরাত): ইহরাম বাঁধার পর থেকে নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন (হজের ক্ষেত্রে কঙ্কর নিক্ষেপের পর প্রথম চুল কাটা/মুন্ডন, ওমরাহর ক্ষেত্রে তাওয়াফ-সায়ী শেষে চুল কাটা) পর্যন্ত কিছু কাজ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এগুলো এড়িয়ে চলা ওয়াজিব। “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এ এই নিষেধাজ্ঞাগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়:
- চুল-দাড়ি কাটা বা নখ কাটা: শরীরের কোনো রোম বা নখ কাটা, ছাঁটা বা উপড়ে ফেলা যাবে না।
- সুগন্ধি ব্যবহার: শরীরে, কাপড়ে বা খাবারে কোনো ধরনের সুগন্ধি (পরফিউম, সেন্টেড সাবান, তেল ইত্যাদি) ব্যবহার করা যাবে না। ইহরামের আগে ব্যবহার করা সুগন্ধির চিহ্ন থাকলে সমস্যা নেই।
- শিকার করা বা শিকারে সাহায্য করা: ইহরাম অবস্থায় স্থলচর কোনো প্রাণী শিকার করা বা শিকারে সরাসরি সাহায্য করা হারাম। মাক্কা হারাম এলাকায় তো যেকোনো সময় শিকার নিষিদ্ধ।
- যৌনাচার বা তার দিকে নিয়ে যাওয়া কোনো কাজ: স্ত্রী-সহবাস, চুম্বন, স্পর্শ কামনা-বাসনাপূর্ণ হওয়া – এসব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি বিবাহ বন্ধনও ইহরাম অবস্থায় জায়েজ নয়।
- ঝগড়া-বিবাদ বা অশ্লীল কথা: কোনো প্রকার কলহ, বাকবিতণ্ডা, গালাগালি, অশ্লীল বা কুরুচিপূর্ণ কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। (কুরআন ২:১৯৭)
- সেলাইকৃত কাপড় পরা (পুরুষের জন্য): পুরুষরা জুতা বা স্যান্ডেল পরতে পারবেন, তবে এমন নয় যাতে পায়ের টাখনু ঢাকা পড়ে। মোজা পরা যাবে না। মাথা বা মুখ ঢাকার জন্য বিশেষ কাপড় (টুপি, স্কার্ফ ইত্যাদি) ব্যবহার করা যাবে না (ছাতা ব্যবহারের অনুমতি আছে)। মহিলারা হাত ও মুখ খোলা রেখে সাধারণ সেলাই করা পোশাক পরতে পারেন।
- মুখ বা হাত ঢাকা (পুরুষের জন্য): পুরুষদের মুখমণ্ডল বা হাতের তালু ইচ্ছাকৃতভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না (ঘুমের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে ঢেকে গেলে সমস্যা নেই)।
ইহরামের এই নিয়মগুলো যথাযথভাবে পালন করা হজ বা ওমরাহর কবুলিয়াতের জন্য অপরিহার্য। সামান্য অসতর্কতায় ফিদইয়া (জরিমানা স্বরূপ কোরবানি বা সদকা) দিতে হতে পারে। তাই “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এই অংশে বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
হজ ও ওমরাহর মূল আমল: তাওয়াফ, সায়ী ও হালক/কসর
ইহরামের পরেই আসে হজ বা ওমরাহর মূল স্তম্ভগুলোর পালন। এই অংশগুলোই হজ বা ওমরাহর প্রকৃত রূপ। “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এই আমলগুলোকে অত্যন্ত সহজ ও ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করে, যাতে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে।
তাওয়াফ (কাবা প্রদক্ষিণ): ওমরাহ এবং হজ উভয় ক্ষেত্রেই তাওয়াফ একটি অপরিহার্য অংশ (ওমরাহর জন্য একটি, হজের জন্য দুটি – কুদুম ও ইফাদা/জিয়ারত তাওয়াফ)।
- প্রস্তুতি: প্রথমে হাতিমের সামনে এসে (বা যেখান থেকে সম্ভব) কাবাকে বাম দিকে রেখে তাওয়াফ শুরু করতে হয়। শরীর পবিত্র হওয়া (ওজু) আবশ্যক। পুরুষের জন্য প্রথম তিন চক্করে রমল (বুক ফুলিয়ে, কাঁধ নাড়িয়ে দ্রুত হাঁটা) এবং পরের চার চক্করে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা সুন্নত।
- নিয়ত: মনে মনে তাওয়াফের নিয়ত করা।
- শুরু: হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) কোণ থেকে বা তার সমতলে এসে তাকবির (আল্লাহু আকবার) বা বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে হাত তুলে ইশারা করা (ইস্তিলাম)। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা সুন্নত, কিন্তু ভিড়ের কারণে ইশারাই যথেষ্ট। প্রতিটি চক্করের শুরুতে হাজরে আসওয়াদের দিকে এভাবে ইশারা করতে হয়।
- দোয়া ও জিকির: তাওয়াফের সময় নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই। নিজ ভাষায় (বাংলায়ও) আল্লাহর কাছে দোয়া, ক্ষমা প্রার্থনা, কুরআন তিলাওয়াত, সাধারণ জিকির (সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু) করা যায়। রুকনে ইরাকি (তৃতীয় কোণ) ও রুকনে শামি (চতুর্থ কোণ) এর মধ্যবর্তী স্থানে “রাব্বানা আতিনা…” দোয়া পড়া বিশেষ ফজিলতপূর্ণ বলে জানা যায়।
- মুলতাজাম: হাজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মধ্যবর্তী স্থান। এখানে দোয়া কবুল হওয়ার আশায় দোয়া করা যায় (ভিড়ের অবস্থা বিবেচনা করে)।
- তাওয়াফ শেষে: সাত চক্কর পূর্ণ করার পর, মাকামে ইবরাহিমের পেছনে (বা মসজিদের অন্য কোথাও) দুই রাকাত ওয়াজিব সালাত আদায় করতে হয়। এরপর যমজম পানি পান করা সুন্নত।
সায়ী (সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে দৌড়ানো): তাওয়াফের পরই সায়ী করতে হয়। এটি হাজেরা (আ.) এর আত্মত্যাগ ও আল্লাহর উপর অবিচল আস্থার স্মরণে পালন করা হয়।
- প্রস্তুতি: সাফা পাহাড়ে উঠে কাবার দিকে ফিরে তাকবির, তাহমিদ ও দরুদ পড়ে দোয়া করা।
- শুরু: সাফা থেকে মারওয়ার দিকে হাঁটা শুরু করা। দুই সবুজ স্তম্ভের (বর্তমানে আলোকিত চিহ্ন) মধ্যবর্তী স্থানে পুরুষদের দ্রুত দৌড়ানো (হারওয়ালা) সুন্নত। বাকি পথ স্বাভাবিক গতিতে হাঁটতে হয়। মারওয়ায় পৌঁছে সাফার মতোই দোয়া করতে হয়।
- পূর্ণতা: সাফা থেকে মারওয়া একবার গমন এবং মারওয়া থেকে সাফায় ফিরে আসা – এটাই এক চক্কর। এভাবে সাত চক্কর সম্পন্ন করতে হয়। মারওয়ায় সপ্তম চক্কর শেষ হলে সায়ী সম্পন্ন হয়।
- দোয়া: সায়ীর সময়ও নির্দিষ্ট দোয়া নেই। নিজের মনের কথাই আল্লাহর কাছে জানানো যায়, বিশেষ করে দুই সবুজ স্তম্ভের মাঝে দ্রুত দৌড়ানোর সময়।
- হালক বা কসর (চুল ছোট করা বা মুন্ডন): সায়ী শেষ করার পরই ওমরাহ সম্পন্ন হয় এবং ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চুল কাটতে হয়। পুরুষদের জন্য মুন্ডন (হালক) উত্তম, তবে চুল ছোট করাও (কসর) জায়েজ। মহিলাদের জন্য শুধু এক অঙ্গুলির ডগা পরিমাণ চুলের প্রান্ত ছাঁটাই (কসর) করাই বিধান। এই কাজটি মারওয়ার পাশেই নির্দিষ্ট স্থানে (সাধারণত পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা) করা হয়। চুল কাটার মাধ্যমেই ওমরাহ শেষ হয় এবং ইহরামের নিষেধাজ্ঞাগুলো রহিত হয়ে যায়।
হজের জন্য ওমরাহ (তামাত্তু) বা কিরান পদ্ধতিতে আগতরা: তারা ওমরাহর এই হালক/কসরের পর ইহরাম খুলে ফেলতে পারে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। শুধু ৮ জিলহজ্জ পুনরায় ইহরাম বেঁধে হজের মূল আমলগুলো শুরু করবে।
ইফরাদ পদ্ধতিতে আগতরা (যারা শুধু হজের নিয়তে এসেছেন): তারা এই হালক/কসর করবে না। তারা হজের মূল আমল (৮ জিলহজ্জ থেকে) ইহরাম অবস্থায়ই সম্পন্ন করবে এবং শুধু ১০ জিলহজ্জ কঙ্কর নিক্ষেপের পর হালক/কসর করবে।
হজের মূল আমল: আরাফাত, মুজদালিফা ও মিনায় অবস্থান
যারা হজের জন্য এসেছেন (তামাত্তু, কিরান বা ইফরাদ যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন), তাদের জন্য হজের মূল আমল শুরু হয় ৮ জিলহজ্জ থেকে। এই অংশটি হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন পর্ব। “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এই দিনগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়:
৮ জিলহজ্জ: মিনায় প্রবেশ ও অবস্থান (তারবিয়ার দিন): এই দিন সকালে মক্কা থেকে মিনায় গিয়ে তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়। সারা দিন ও রাত মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। এই দিনে জোহর, আসর, মাগরিব ও এশা – এই চার ওয়াক্ত সালাত যথাক্রমে জোহর, আসর, মাগরিব ও এশার ওয়াক্তে আদায় করতে হবে (কসর বা জমা নয়)। দিনটি ইবাদত-বন্দেগি, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও প্রস্তুতিতে কাটাতে হয়। তামাত্তু ও কিরান হাজিরা এই দিন ভোরে মক্কা থেকে ইহরাম বেঁধে মিনায় আসবেন।
৯ জিলহজ্জ: আরাফাতের দিন (হজের রুকন): এই দিনই হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুকন – আরাফাতের ময়দানে অবস্থান। সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়। আরাফাতের নির্ধারিত সীমানার ভেতরে ৯ জিলহজ্জ যোহর থেকে ১০ জিলহজ্জ ফজর পর্যন্ত যে কোনো সময় কিছুক্ষণ (এমনকি কয়েক মিনিট) অবস্থান করলেই হজের এই ফরজ আদায় হয়ে যাবে। তবে সুন্নত হলো জোহর ও আসরের সালাত যোহরের ওয়াক্তে একত্রে (জমা তাকদীম) ও কসর করে আদায় করে দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা।
- আরাফাতের আমল: এই সময়টি গভীর অনুশোচনা, ক্ষমা প্রার্থনা, দোয়া, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত ও কাঁদাকাটিতে কাটানো উচিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, “হজ হলো আরাফাত।” (তিরমিজি)। যত বেশি দোয়া ও ইস্তিগফার করা যায়, ততই ভালো। বিশেষ করে দোয়ায়ে আরাফাহ (আল্লাহর রাসূল (সা.) এর শিখানো দোয়া) পড়ার চেষ্টা করা উচিত। সূর্যাস্তের পর ধীরে সুস্থে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়।
৯ জিলহজ্জ সন্ধ্যা/রাত: মুজদালিফায় অবস্থান (ওয়াজিব): আরাফাত থেকে মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশার সালাত এশার ওয়াক্তে একত্রে (জমা তাখীর) ও কসর করে আদায় করতে হয়। পুরো রাত মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। তবে মহিলা, শিশু, অসুস্থ ও বৃদ্ধরা রাতের শেষ তৃতীয়াংশের পর মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারেন। মুজদালিফার মাটিতে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া সুন্নত। এখান থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৯টি বা অন্তত ২১টি কঙ্কর সংগ্রহ করতে হয় যা পরের দিনগুলোতে জামারাতে নিক্ষেপের কাজে লাগবে।
১০ জিলহজ্জ: ঈদের দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহ:
- ফজরের সালাত: মুজদালিফায় ফজরের সালাত আদায় করে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকা।
- মাশআরুল হারামে অবস্থান: সূর্যোদয়ের কিছু আগে মুজদালিফার ‘মাশআরুল হারাম’ (পাহাড়ের নিকটবর্তী এলাকা) এলাকায় গিয়ে কিছুক্ষণ দোয়া করা মুস্তাহাব।
- মিনায় যাত্রা ও কঙ্কর নিক্ষেপ (জামরাতুল আকাবা): সূর্যোদয়ের পর মিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হয়। মিনায় পৌঁছে প্রথম কাজ হলো বড় শয়তানকে নির্দেশিত স্থানে (জামরাতুল আকাবা) ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা। প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপের সময় “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলা। এই নিক্ষেপের মাধ্যমেই হজের পরবর্তী স্তরে প্রবেশ করা হয়। এই নিক্ষেপের পরেই ইহরামের অনেক নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়, তবে স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ থাকে।
- কোরবানি করা (ওয়াজিব – তামাত্তু ও কিরান হাজির জন্য): কঙ্কর নিক্ষেপের পর কোরবানি করতে হয় (১০, ১১ বা ১২ জিলহজ্জের মধ্যে)। তামাত্তু ও কিরান পদ্ধতির হাজির জন্য কোরবানি ওয়াজিব। ইফরাদ হাজির জন্য ওয়াজিব নয়, তবে সুন্নত। সাধারণত হজ এজেন্সির মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে কোরবানি করা হয়।
- হালক বা কসর (মুন্ডন/চুল ছাটাই): কোরবানির পর পুরুষদের মাথা মুন্ডানো (হালক) বা চুল ছোট করা (কসর) এবং মহিলাদের এক অঙ্গুলি পরিমাণ চুলের প্রান্ত কাটা (কসর)। এই কাজটি সম্পন্ন করলেই ইহরামের বাকি সব নিষেধাজ্ঞা (যেমন সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাইকৃত কাপড় পরা – পুরুষের জন্য) রহিত হয়ে যায়। শুধু স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ থাকে তাওয়াফে জিয়ারত না করা পর্যন্ত। হালক/কসরের পর ইহরাম খুলে সাধারণ পোশাক পরা যায়।
- তাওয়াফে জিয়ারত (ইফাদা) ও সায়ী: এই দিন বা এর পরের দিনগুলোতে (১১, ১২ বা ১৩ জিলহজ্জের মধ্যে) মক্কায় ফিরে তাওয়াফে জিয়ারত (যা হজের একটি রুকন) এবং এরপর সায়ী (হজের জন্য ওয়াজিব) সম্পন্ন করতে হয়। এই তাওয়াফ ও সায়ী শেষ করার পরই স্ত্রী সহবাস সহ সব নিষেধাজ্ঞা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ হয়। অনেকেই ১০ তারিখেই সময় করে মক্কায় গিয়ে এই তাওয়াফ ও সায়ী সেরে ফেলেন।
- ১১ ও ১২ জিলহজ্জ (অথবা ১৩ জিলহজ্জ): মিনায় অবস্থান ও তিন জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ (আয়্যামে তাশরিক): ১০ তারিখের কাজ শেষ করে আবার মিনায় ফিরে আসতে হয়। ১১ ও ১২ জিলহজ্জ দিনে তিনটি জামারাতেই (ছোট, মধ্যম, বড়) যথাক্রমে প্রতিটিতে ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়। প্রতিদিন যোহরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর থেকে নিক্ষেপ করা যায়। “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এ জোর দেওয়া হয় যে প্রতিটি জামারাতে নিক্ষেপের সময় সঠিক স্থানে (গর্তে) পড়ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে এবং নিক্ষেপের পর দ্রুত সরে যেতে হবে যাতে অন্যের অসুবিধা না হয়। এই দিনগুলোতে মিনায় অবস্থান করা ওয়াজিব। যারা তাশরিকের ১৩ তারিখেও মিনায় থাকবেন (যাকে নফল তাশরিক বলা হয়), তারা ১৩ তারিখেও তিন জামারাতে ৭টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। ১২ জিলহজ্জ সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করলে ১৩ তারিখের কঙ্কর নিক্ষেপ ওয়াজিব হবে না।
বিশেষ বিবেচ্য বিষয়: মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশু হাজিদের জন্য নিয়মাবলী
“হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এ বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেইসব হাজিদের উপর যাদের জন্য কিছুটা ভিন্নতা বা ছাড় রয়েছে:
মহিলা হাজিদের জন্য:
- ইহরাম: সাধারণ পোশাক (সেলাইকৃত) পরতে পারেন, মুখ ও হাতের তালু ছাড়া শরীর ঢাকা আবশ্যক। সুগন্ধি ব্যবহার, নখ কাটা, চুল কাটা, সেলাইকৃত পোশাক পরা – এসব ক্ষেত্রে পুরুষদের মতোই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য। তবে মাথা ঢাকা যাবে না – এমন নয়।
- হাইজ-নিফাস: হজ বা ওমরাহর আমল (তাওয়াফ, সায়ী, আরাফাতের অবস্থান, কঙ্কর নিক্ষেপ) করার সময় পবিত্র থাকা জরুরি। ঋতুস্রাব বা সন্তান প্রসব পরবর্তী রক্তস্রাব (নিফাস) চলাকালীন তাওয়াফে জিয়ারত, তাওয়াফে কুদুম (প্রথম তাওয়াফ) বা ওমরাহর তাওয়াফ করা জায়েজ নয়। তবে সায়ী, আরাফাত-মুজদালিফায় অবস্থান, কঙ্কর নিক্ষেপ করা যায়। পরে পবিত্র হয়ে তাওয়াফ আদায় করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে আলেমদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
- রমল ও হারওয়ালা: পুরুষদের মতো রমল (তাওয়াফে দ্রুত হাঁটা) বা হারওয়ালা (সায়ীতে দৌড়ানো) করতে হবে না। স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন।
- হালক/কসর: মুন্ডন নয়, শুধু এক অঙ্গুলির ডগা পরিমাণ চুলের প্রান্ত কাটাই (কসর) যথেষ্ট।
- ভিড় এড়ানো: সম্ভব হলে অতি ভিড়ের সময় (জোহর, আসরের পরের সময়, রাতের শেষভাগ) তাওয়াফ, সায়ী বা কঙ্কর নিক্ষেপ করা ভালো। নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
- মাহরাম: একাকী হজ বা ওমরাহ করতে পারবেন না। শরীয়তসম্মত মাহরাম (স্বামী, পিতা, ভাই, পুত্র, চাচা ইত্যাদি নিষিদ্ধ আত্মীয়) সঙ্গে থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকারও মহিলাদের জন্য মাহরামসহ হজ আবেদনের শর্ত জারি করে।
বৃদ্ধ, দুর্বল ও অসুস্থ হাজিদের জন্য:
- প্রতিনিধি (নায়েব): যারা শারীরিকভাবে তাওয়াফ, সায়ী বা কঙ্কর নিক্ষেপ করতে অক্ষম, তারা অন্যকে দিয়ে তা করিয়ে নিতে পারেন (নায়েব নিয়োগ)। তবে নায়েবের জন্য নিজের হজ আদায় করা আবশ্যক এবং প্রতিটি আমলের জন্য আলাদা নায়েব নিয়োগ করতে হবে না – একজনই সব করতে পারেন। নায়েবের জন্য নিজের পক্ষে নিয়ত করা জরুরি। নায়েব নিয়োগের বিস্তারিত ফিকহী নিয়ম আলেমের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত।
- যানবাহনের ব্যবহার: তাওয়াফ ও সায়ীর স্থানে (মসজিদুল হারামে) সাধারণত হুইলচেয়ার ব্যবহারের সুব্যবস্থা থাকে। বৃদ্ধ বা অসুস্থরা হুইলচেয়ারে বসে তাওয়াফ ও সায়ী করতে পারেন। তবে সায়ীর ক্ষেত্রে হুইলচেয়ারে বসে সাত চক্কর পূর্ণ করলেই হবে, হারওয়ালার প্রয়োজন নেই। কঙ্কর নিক্ষেপের স্থানেও সহায়তা পাওয়া যায়।
- সময়সূচি: ভিড় এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত শীতল ও কম ভিড়ের সময় আমলগুলো আদায়ের চেষ্টা করা উচিত।
- শিশু হাজিদের জন্য:
- বয়স ও বোঝার ক্ষমতা: যে শিশু হজের আমলগুলো বুঝে ও নিজে করতে সক্ষম, তার হজ আদায় হয়ে যাবে। নাবালেগ শিশুর হজ করালে সে বড় হলে আবার হজ করতে হবে কি না – এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। তবে ছোটবেলা থেকেই এই পবিত্র অভিজ্ঞতা দেওয়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হলো, নাবালেগের হজ নফল হিসেবে গণ্য হবে এবং বালেগ হওয়ার পর তার উপর ফরজ হজ আদায় করা আবশ্যক।
- দায়িত্ব: শিশুর সার্বিক দেখাশোনা, নিরাপত্তা এবং আমলগুলো ঠিকমতো করানো অভিভাবকের দায়িত্ব। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার ভয় সর্বদা থাকে, তাই বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। শিশুকে সহজ ভাষায় হজের নিয়ম বোঝানো দরকার।
সাধারণ ভুল ও সতর্কতা: আপনার হজ-ওমরাহকে নিখুঁত করার পরামর্শ
“হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” শুধু নিয়মই বলে না, বরং সাধারনত যে ভুলগুলো হয়, সেগুলো শুধরানোর দিকেও নজর দেয়:
- নিয়তের ঘাটতি: শুধু রীতি পালন বা লোক দেখানোর জন্য হজ-ওমরাহ না করা। আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা সর্বাগ্রে।
- জ্ঞানের অভাব: অন্যের দেখাদেখি বা আন্দাজে আমল না করা। প্রতিটি আমলের ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নত স্পষ্টভাবে জানা। প্রশ্ন করতে লজ্জা না করা।
- ইহরামের নিয়ম লঙ্ঘন: অসাবধানতাবশত চুল-নখ কাটা, সুগন্ধি লাগানো, পুরুষের সেলাইকৃত পোশাক পরা বা মাথা ঢাকা – এসব এড়াতে সতর্ক থাকা। ভুলবশত হলে ফিদইয়া (জরিমানা) দিতে হবে।
- তাওয়াফ-সায়ীর ভুল: তাওয়াফ শুরু ও শেষের স্থান (হাজরে আসওয়াদ), চক্করের সংখ্যা (৭), কাবার বাম দিক বজায় রাখা, সায়ীর চক্কর সংখ্যা (৭), হারওয়ালার স্থান – এসব সঠিকভাবে পালন করা।
- কঙ্কর নিক্ষেপে অবহেলা: প্রতিটি জামারাতে ঠিক ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা, সঠিক স্থানে (গর্তে) নিক্ষেপ করা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (যোহর শুরু থেকে পরদিন ফজর পূর্ব পর্যন্ত) নিক্ষেপ করা। ভিড়ের কারণে অন্যের কঙ্কর নিক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা। কঙ্কর নিক্ষেপের সময় সঠিক নিয়ম মেনে নিরাপত্তা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- তাওয়াফে জিয়ারত বিলম্ব বা ভুলে যাওয়া: হজের এই রুকনটি (১০,১১,১২ বা ১৩ জিলহজ্জের মধ্যে) অবশ্যই আদায় করতে হবে। এটি ছাড়া হজ সম্পূর্ণ হয় না।
- অতিরিক্ত আমলে বিভ্রান্তি: ফরজ ও ওয়াজিব আমল পূর্ণ করার পর নফল আমলে আত্মনিয়োগ করা ভালো। কিন্তু ফরজ-ওয়াজিবের চেয়ে নফল আমলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া (যেমন নির্দিষ্ট স্থানের দোয়া বা জিকিরের পেছনে বেশি সময় দেওয়া) ঠিক নয়।
- ভিড় ও ধৈর্য্যহীনতা: হজের সময় বিপুল ভিড় স্বাভাবিক। ধৈর্য ধারণ করা, অন্য হাজিদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা, ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি বা ঝগড়া-বিবাদ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা অপরিহার্য। (কুরআন ২:১৯৭ – “হজের মাসগুলো সুনির্দিষ্ট… সুতরাং তোমরা সেখানে পাপাচার, বিতণ্ডা ও ঝগড়া-বিবাদ করো না।”)
- আর্থিক অসততা: হজের খরচ হালাল উপার্জন থেকে হওয়া চাই। রিযিকের হালাল-হারামের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। হজ এজেন্সি নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
- স্থানীয় নিয়ম ও নির্দেশনা অমান্য: সৌদি সরকার কর্তৃক জারি করা বিভিন্ন নির্দেশনা (যেমন নির্দিষ্ট চলাচল পথ, সময়সূচি, নিরাপত্তা বিধি) মেনে চলা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশি হজ মিশনের নির্দেশনাও গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ নোট: “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” একটি সহায়ক উপকরণ মাত্র। ফিকহের সূক্ষ্ম বিধান, বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয় (যেমন মহিলার হায়েয সংক্রান্ত সমস্যা, অসুস্থতা, হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি) এবং সর্বশেষ সরকারি নির্দেশনা জানার জন্য সর্বদা বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় (https://mora.gov.bd/) বা সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ের (https://www.haj.gov.sa/) অফিসিয়াল ওয়েবসাইট চেক করা এবং নিকটস্থ বিশুদ্ধ আকিদার আলেম বা মুফতির পরামর্শ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। কিছু নিয়ম সময় ও পরিস্থিতিভেদে পরিবর্তিত হতে পারে।
জেনে রাখুন (FAQs)
হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: হজ ও ওমরাহর মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
- উত্তর: হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ, যা জীবনে একবার ফরজ (সক্ষম ব্যক্তির উপর)। এটি পালিত হয় নির্দিষ্ট মাসে (জিলহজ্জ) এবং নির্দিষ্ট দিনে (৮-১২/১৩ জিলহজ্জ)। এর রীতিনীতি আরও জটিল ও দীর্ঘ। অন্যদিকে, ওমরাহ একটি নফল ইবাদত, যা বছরের যেকোনো সময় করা যায়। এতে ইহরাম, তাওয়াফ, সায়ী ও হালক/কসর – এই চারটি আমল থাকে। হজের তুলনায় এর নিয়ম সহজ ও সময় স্বল্প। “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এ উভয়ের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার জন্য কি ভিসা লাগে? কিভাবে আবেদন করব?
- উত্তর: হ্যাঁ, হজের জন্য সৌদি আরবের ভিসা আবশ্যক। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি (প্রাইভেট) – দুইভাবে হজ করা যায়। সরকারি হজে আবেদন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত যেকোনো শাখায় হজ ডিপোজিট স্কিমে টাকা জমা দিয়ে অনলাইন আবেদন (https://hajj.gov.bd/) করতে হয়। বেসরকারি হজের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় অনুমোদিত হজ এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এজেন্সিই ভিসা প্রক্রিয়ার দেখাশোনা করে থাকে। আবেদনের সময়সীমা ও শর্তাবলী প্রতি বছর সরকার ঘোষণা করে।
প্রশ্ন: হজ বা ওমরাহর সময় মহিলাদের ঋতুস্রাব (হায়েয) হলে কী করণীয়?
- উত্তর: ঋতুস্রাব অবস্থায় তাওয়াফ (কাবা প্রদক্ষিণ) করা জায়েজ নয়। তাই যদি ওমরাহর তাওয়াফ বা হজের তাওয়াফে জিয়ারতের সময় হায়েয শুরু হয়, তবে পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাওয়াফ আদায় করতে হবে। তবে সায়ী, আরাফাত-মুজদালিফায় অবস্থান, কঙ্কর নিক্ষেপ করা যায়। ওমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধা অবস্থায় হায়েয শুরু হলে পবিত্র হওয়ার পর তাওয়াফ ও সায়ী করে হালক/কসর করতে হবে। এই বিষয়ে জটিলতা এড়াতে আগে থেকেই সম্ভাব্য সময় মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা এবং প্রয়োজনে আলেমের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: হজের তিন পদ্ধতি (তামাত্তু, কিরান, ইফরাদ) বলতে কী বোঝায়? কোনটি উত্তম?
- উত্তর: তামাত্তু: শাওয়াল, জিলকদ বা জিলহজ্জের প্রথম ৭ দিনে ওমরাহ করে ইহরাম খুলে স্বাভাবিক পোশাক পরে থাকা, তারপর ৮ জিলহজ্জে হজের জন্য নতুন করে ইহরাম বাঁধা। এই পদ্ধতিতে একটি কোরবানি ওয়াজিব। কিরান: হজ ও ওমরাহর একসাথে নিয়ত করে একই ইহরামে উভয় ইবাদত আদায় করা। এটিও তামাত্তুর মতো কোরবানি ওয়াজিব করে। ইফরাদ: শুধু হজের নিয়ত করে ইহরাম বাঁধা, ওমরাহ করা হয় না। এতে কোরবানি ওয়াজিব নয়। “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” অনুসারে, তামাত্তু পদ্ধতিই রাসূল (সা.) এর প্রতি অনুসরণের দিক থেকে উত্তম এবং তিনি সাহাবাদেরকেও এই পদ্ধতিতে উৎসাহিত করেছেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ হাজিই তামাত্তু পদ্ধতিতে হজ করেন।
প্রশ্ন: হজ বা ওমরাহ শেষে দেশে ফিরে কী করণীয়?
- উত্তর: দেশে ফিরে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। হজ কবুল হওয়ার জন্য বেশি বেশি দোয়া করা চাই। হজের অভিজ্ঞতা পরিবার ও সমাজের সাথে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, তবে কোনো রকামি বা অহংকার করা যাবে না। হজের পরের জীবনকে ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর আনুগত্যে আরও নিবেদিত করার দৃঢ় সংকল্প নেওয়া উচিত। হজের সময় কৃত কোনো ভুল বা ত্রুটির জন্য তওবা-ইস্তিগফার করা উচিত।
- প্রশ্ন: ওমরাহ করার সহজ নিয়ম কি? হজের চেয়ে কি কম সময় লাগে?
- উত্তর: হ্যাঁ, ওমরাহর নিয়ম হজের চেয়ে সরল এবং সময়ও কম লাগে। ওমরাহর মূল চারটি আমল: (১) মিকাতে বা নির্ধারিত স্থানে ইহরাম বাঁধা ও নিয়ত করা, (২) মক্কায় পৌঁছে কাবা শরীফের তাওয়াফ (৭ চক্কর), (৩) সাফা-মারওয়ার মধ্যে সায়ী (৭ চক্কর), (৪) চুল ছোট করা বা মুন্ডন (পুরুষের জন্য মুন্ডন বা ছাঁটা, মহিলাদের জন্য শুধু প্রান্ত ছাঁটা)। এই আমলগুলো একদিনে বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সম্পন্ন করা যায়। তাই হজের মতো দীর্ঘ সময় (কয়েক সপ্তাহ) না থাকলেও ওমরাহ করা অনেকের জন্য সহজসাধ্য। “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” এ ওমরাহর ধাপগুলো সহজ ভাষায় বর্ণনা করা আছে।
সতর্কতামূলক মন্তব্য: এই গাইডে প্রদত্ত তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস ও প্রামাণ্য ফিকহ গ্রন্থের আলোকে উপস্থাপিত। তবে ইসলামিক আইনশাস্ত্রের (ফিকহ) কিছু বিষয়ে বিভিন্ন মাজহাবভিত্তিক সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকতে পারে। এছাড়া, হজ ও ওমরাহ সংক্রান্ত প্রশাসনিক নিয়ম (যেমন ভিসা, স্বাস্থ্যবিধি, মিকাতের সুনির্দিষ্ট স্থান, নিরাপত্তা নির্দেশনা ইত্যাদি) বাংলাদেশ ও সৌদি আরব সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হতে পারে। সুতরাং, আপনার হজ বা ওমরাহ পালনের পূর্বে সর্বশেষ সরকারি নির্দেশনা (বাংলাদেশ ধর্ম মন্ত্রণালয়: https://mora.gov.bd/ এবং সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়: https://www.haj.gov.sa/) অবশ্যই যাচাই করে নিন এবং প্রয়োজনে আপনার বিশ্বস্ত আলেম বা মুফতির কাছ থেকে আপনার ব্যক্তিগত পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট ফতোয়া (হুকুম) জেনে নিন। কোনো সন্দেহ বা জটিল পরিস্থিতিতে পেশাদার ধর্মীয় নির্দেশনা গ্রহণই সর্বোত্তম পন্থা।
এই “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” আপনার জন্য শুধু একটি বই নয়; এটি আপনার আত্মার সেই পবিত্র যাত্রার দিশারী, যে যাত্রা আপনাকে আল্লাহর সান্নিধ্যের এক অনন্য স্বাদ দেবে। এই গাইডের প্রতিটি পাতায় লুকিয়ে আছে সেই জ্ঞান, যা আব্দুর রহমানের মতো সাধারণ মানুষকে মক্কার মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল এক অসাধারণ মুহূর্তের মুখোমুখি। হজ বা ওমরাহ কখনোই শুধু কয়েকটি আনুষ্ঠানিকতার সমষ্টি নয়; এটি হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত এক আত্মসমর্পণ, এক গভীর পুনর্মিলন আপনার স্রষ্টার সাথে। নিয়মের কঠিন পথ পেরিয়ে যে প্রশান্তি আসে, তা-ই তো এই সফরের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাই ভয়কে জয় করুন, জ্ঞানের আলোকে নিজেকে সজ্জিত করুন, এবং “হজ ও ওমরাহর নিয়মাবলী: সহজ গাইড” কে সঙ্গী করে সেই অনন্ত সুখের পথে এগিয়ে যান। আজই শুরু করুন আপনার প্রস্তুতি, যোগাযোগ করুন একটি নির্ভরযোগ্য হজ এজেন্সির সাথে, এবং আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন – “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক!”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।