জুমবাংলা ডেস্ক: চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ দুর্নীতি এবং সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে চলছে অভিযান। চলমান এই অভিযানে ছাত্রলীগ, যুবলীগের পর নতুন লক্ষ্য কী হচ্ছে- তা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে চলছে নানা আলোচনা।
দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও কৌতুহলের শেষ নেই। তাঁদের প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে কেন দল ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে টানা তৃতীয় দফায় দাপটের সাথেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিও নেই কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করার মতো অবস্থানে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক বড় দুর্বলতা হচ্ছে গত দুই নির্বাচন। দুটি নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁদের নেতৃত্ব এই দুর্বলতার বিষয়টি অনুধাবন করে। সেজন্য উন্নয়নের গণতন্ত্রের স্লোগান দিয়েছে আওয়ামী লীগ বা সরকার। দাতাদের সহায়তা ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে ভিত্তি করে মানুষের সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা তাঁদের রয়েছে।
এই উন্নয়নের গণতন্ত্রের স্লোগান নিয়েও সরকারকে অনেক সমালোচনা সইতে হয়েছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের যাত্রায়ও তাঁরা ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে নিজেদের কিছু নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ডের জন্য।
আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর কিছু নেতা যে দানবের মতো চেহারা নিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন- তা মানুষের মাঝে চাপা ক্ষোভ তৈরি করেছে। পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থায় চলে গেছে আওয়ামী লীগের। অনেকদিন ধরেই এই আলোচনা চলছে আওয়ামী লীগের ভেতরে।
এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে মানুষের মাঝে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইছে বলে মনে হয়েছে। এখনকার অভিযানের পেছনে এটিকেই অন্যতম একটি বড় কারণ বলা যেতে পারে।
দল এবং সরকারকে রক্ষার কোন চেষ্টাও থাকতে পারে সম্প্রতি একটি হাসপাতালের পর্দা কেনা থেকে শুরু করে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশ কেনা- বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতির খবর ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে, যা সরকারকে বেশ বিব্রত করেছে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর অনেকের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের কারণে মানুষের মাঝে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ বড় ইস্যু হয়ে উঠছে।
সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ বা সরকারের অস্তিত্বই সংকটে পড়ছে, সেটি আওযামী লীগ নেতৃত্ব বা সরকারের অজানা নয়। বিষয়টি আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করেছে। ফলে দলের অস্তিত্ব বা সরকারকে রক্ষা করার বিষয়ও একটি কারণ হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে এমন একটি অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা রয়েছে যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বই পারে নিজেদের দলে বা সরকারের ভেতরে স্বচ্ছ্বতা আনতে। দুর্নীতি দমনে অন্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে-এমন আলোচনার সুযোগ যাতে না হয়, এখনকার অভিযানের পেছনে এই বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে বলে মনে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যেহেতু গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, মানবাধিকার লংঘন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা–এমন সব অভিযোগের মুখে রয়েছে, সেজন্য দুর্নীতি বিরোধী একটি অবস্থান তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে কাছে টানার একটি চেষ্টাও থাকতে পারে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ বা সরকারের জন্য কোনো সংকট হলে, শেখ হাসিনার দিকেই তাকিয়ে থাকেন দলের নেতাকর্মীরা। ফলে দলে বা সরকারে শেখ হাসিনার একক ভাবমূর্তির ওপর নির্ভরশীলতার বিষয় তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি এবং সরকারের কাজের স্বচ্ছ্বতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার একটা চেষ্টাও রয়েছে বলে মনে হয়।
অপরাধে জড়িতদের সতর্ক করা হযেছিল শেখ হাসিনা ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করে অভিযান চালানোসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তাঁর দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যাটি একদিনে তৈরি হয়নি, আওয়ামী লীগেই বড় অংশের নেতাকর্মীদের মাঝে কিছু নেতাকর্মীর অপরাধে জড়ানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা ছিল অনেকদিন ধরে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের বার বার সতর্ক করার পরও পরিবর্তন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী এখন কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, নেত্রী দল বা সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল বা নেতাদের ব্যাপারে অনেকের কাছ থেকে তথ্য নেন। কর্মীদের কাছ থেকে তথ্য নেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আছে, তাদের কাছ থেকেও তথ্য নিয়েছেন। যখন সীমা লঙ্ঘন করছে, তখন তিনি নানাভাবে চেষ্টা করেছেন, এদের নিবৃত্ত করার জন্য। তারা নিবৃত্ত না হয়ে ওই পথে আরো এগিয়েছেন, তখন উনি বাধ্য হয়ে অভিযান চালাচ্ছেন।
সিদ্ধান্ত যেভাবে এসেছে সরকারের পদক্ষেপ বা চলমান অভিযান নিয়ে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে কোনো ধারণা ছিল না। সেজন্য কোনো কোন্দল থেকে দলে বা সহযোগী সংগঠনগুলোতে কোনো অংশকে কোনঠাসা করার জন্য এসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা-এমন অনেক জল্পনাকল্পনাও রয়েছে। তবে দলটির নীতি নির্ধারকরা অভিযান শুরুর আগে একটি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন।
দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে অপরাধে জড়িতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাঁর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। তিনি নিজে অনেক আগেই সহযোগী সংগঠনগুলোসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের যারা নানা অপরাধে জড়িয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে তিনি কেবল নীতিনির্ধারকদের অবহিত করেছেন বলে দলটির অনেকে বলেছেন।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, তাঁদের নেত্রী শেখ হাসিনা অভিযান বা ব্যবস্থাগুলো নেওয়া শুরু করার আগে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে বিষয়টি তুলেছিলেন এবং তাতে সম্মতি নিয়েই এগিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগে আলোচনা যাই হোক না কেন, শেখ হাসিনা নিজে একটি কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- তা নিয়ে এখন দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে কোনো সন্দেহ নেই।
ফলে শেখ হাসিনার এই পদক্ষেপে দল বা পারিবারিক কোন দিক থেকেই বাধা নেই- এমন দাবি করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
মতিয়া বলেন, তাঁদের নেত্রী দলের সম্মতি নিয়েই ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। টানা তৃতীয় দফার এই আওয়ামী লীগ সরকার আগামী বছর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনের বিষয়ও আসছে। এর আগেই একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টাও থাকতে পারে শেখ হাসিনার পদক্ষেপগুলোর ক্ষেত্রে।
আওয়ামী লীগ আসলে কতদূর যাবে এখন অভিযানে যে কয়জন ধরা পড়েছে বা যাদের বিরুদ্ধে আলোচনা হচ্ছে, তাদের কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্র যা প্রকাশ হচ্ছে, দিনের পর দিন তাদেরকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ বা সরকারেরই সমালোচনা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ এমন সমালোচনাকে সাময়িক হিসেবে দেখছেন। দলটি বিবেচনায় রেখেছে, দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক কৌশলগত দিক থেকে এবং তাদের ক্ষমতায় থাকার জন্য ইতিবাচক হবে।
ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সাধারণ মানুষ তাঁদের পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে নিতে শুরু করেছে বলে তাঁরা মনে করছেন।অবৈধভাবে ক্যাসিনো পরিচালনা করা এবং টেন্ডারবাজিসহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে ঢাকায় যুবলীগের দুজন নেতাসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুজন নেতাকে সরিয়ে দেওয়ার পর যুবলীগের অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা যাঁরা দুর্নীতি এবং বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে জড়িত, দলটি তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে।
যদিও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা বা মন্ত্রীরা দুর্নীতি বা সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে আরো কঠোর অভিযান চালানো হবে বলে জানাচ্ছেন। দলের সভানেত্রীর অবস্থান পর্যালোচনা করে একটি ধারণার ভিত্তিতে তাঁরা বলছেন এসব কথা। কিন্তু এখন এই অভিযান বা এসব ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে- সেটি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই।
সূত্র : কালের কন্ঠ/বিবিসি বাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।