হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলকে ব্যবহার করে সহজেই মিলবে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি। ফলে সাড়া পৃথিবীর একমাত্র ভরসা প্রকৃতির জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন সাশ্রয় হবে তার সঙ্গে এই পৃথিবীর মাটি হয়ে উঠবে পরিবেশবান্ধব।
গবেষকরা বলছেন, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল একটি হাইড্রোজেন গ্যাস সমৃদ্ধ ফুয়েল অর্থাৎ জ্বালানি কোষ। এই কোষটিকে দহন করলে তার মধ্যে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন অনু পুড়ে গিয়ে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ, তাপ এবং পানি উৎপন্ন করে। উৎপন্ন হওয়া বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে সঞ্চয় করলে তার থেকে যে শক্তি পাওয়া যাবে তা দিয়ে অতি সহজেই চলবে গাড়ি। এমনকী বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সংস্থায় পাওয়ার গ্রিডের মাধ্যমে ওই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে সহজেই। পাশাপাশি রান্নার গ্যাসের জন্য জ্বালানি হিসাবে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের ব্যবহার করা যাবে বলে দাবি গবেষকদের।
গবেষকরা জানিয়েছেন মূলত একটি ফুয়েল সেল অর্থাৎ কোষ ফুয়েল সেল স্কেলের ওপর কাজ করে। যার প্রধান কাজ রাসায়নিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর ঘটানো। ওই স্কেলে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন ইনপুট হিসাবে ব্যবহার করে তার থেকে তড়িৎ কোষ উৎপন্ন হয়। ওই তড়িৎ কোষগুলি ব্যাটারিতে সঞ্চয় করলে তা থেকে প্রয়োজন মতো বিদ্যুৎ মিলবে সহজেই। এমনকী বিজ্ঞানীরা এও বলেছেন যে কোনও গাড়ির ব্যাটারি মূলত বড় আকারের হয়। কিন্তু হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ অনেক ছোট মাপের ব্যাটারিতে সঞ্চয় করা যাবে। একবার ওই ব্যাটারি চার্জ করলেই ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত গড়াতে পারবে আমাদের সাধের গাড়ি।
হাইড্রোজেন জ্বালানী টেকসই ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানীর ভবিষ্যত রক্ষা করতে সক্ষম। একটি জ্বালানী উৎসের শক্তি, দক্ষতা পরিমাপ করা হয় মধ্যাকর্ষন শক্তি ঘনত্বের (গ্রাভিমেট্রিক এনার্জি ডেনসিটি) মাধ্যমে। যেমন-ডিজেলের গ্রাভিমেট্রিক এনার্জি ডেনসিটি ৪৫এমজে/কেজি, প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে যা ৫৫এমজে/কেজি। এসব জ্বালানীর তুলনায় হাইড্রোজেন সেলের গ্রাভিমেট্রিক এনার্জি ডেনসিটি তিনগুন বেশি (১২০এমজে/কেজির কাছাকাছি)। ফলে দেখা যায় প্রতি পাউন্ড ফুয়েলে তুলনামূলক অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারে হাইড্রোজেন।
বাইরের বাতাস অক্সিজেন ট্যাংকের ফুয়েল সেলের মধ্যে রাখা হাইড্রোজেনের সংস্পর্শে আসে৷ এর ফলে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়, যা দিয়ে ইলেকট্রিক ইঞ্জিন চলে৷ গাড়ির পেছনের এক্সট পাইপ থেকে পানির বিন্দু পড়ে৷ প্রচলিত পেট্রোল বা ডিজেল ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া বের হয় না৷
হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল হালকা, এতে পৃথক কোন যন্ত্রাংশ সংযোজনের প্রয়োজন হয় না, তাই এটি সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করা যায় । তাই মহাশুন্যযানেও হাইড্রোজেন ফুয়েল ব্যবহার করা হয় । এতে কোন শব্দ দূষণ ও তাপীয় দূষণ ঘটে না এবং রিচার্জ করার কোন ঝামেলা নেই ।
যুক্তরাষ্ট্রে মহাসড়কে কয়েকশ হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন তৈরি হয়েছে যা সাধারণ মানুষ ব্যবহার করছে। ইতিমধ্যে শিল্প উৎপন্ন দেশের মহাকাশ যানে, দূরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চলের আবহাওয়া কেন্দ্রে, বড় ধরনের পার্ক, যোগাযোগ কেন্দ্র এবং এমনকি সামরিক স্থাপনায় এর সফল ব্যবহার মানুষকে আশাবাদী করছে।
কোকাকোলা, গুগল, ওয়ালমার্ট, ফেডেক্স, নেসলে ওয়াটার্স, নিশান, ব্রিজস্টোন-এর মতো বিশ্বনন্দিত বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো তাদের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ব্যবহার করছে।
বর্তমানে জাপানে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ১১ মেগাওয়াট ফুয়েল সেল পাওয়ার প্ল্যান্ট কার্যকর করেছে এবং এ পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
বাজারে এখন দুটি ফুয়েল সেল গাড়ি পাওয়া যায়: হুন্দাই টাকসন এবং টয়োটা মিরাই। সম্প্রতি হাইড্রোজন জ্বালানি দ্বারা চালিত টয়োটা মিরাই ভারতে প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ির আগমন হয়। গাড়িটি সম্পূর্ণভাবে হাইড্রোজেন জেনারেটেড ইলেকট্রিসিটি দ্বারা চালিত হবে। শূন্য কার্বন নির্গমণ করতে সক্ষম এই টয়োটা মিরাই। যার ফলে কোনও দূষণ হবে না। মাত্র কয়েক ফোঁটা পানি বর্জ্য হিসেবে নির্গত হবে। একটা ইলেকট্রিক গাড়ি চার্জ হতে যেখানে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় নেয়, ঠিক সেখানেই হাইড্রোজেন ফুয়েল দ্বারা চালিত এই টয়োটা মিরাই মাত্র ৫ মিনিটেই হাইড্রোজেন রিফিল করবে।
বাংলাদেশে জ্বালানিসাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে উন্নত দেশ গড়ার গবেষণার অংশ হিসেবে জাপান থেকে আনা একটি গাড়ি প্রকল্পের আওতায় সরকারিভাবে কেনা হয়েছে। গাড়িটি বিসিএসআইআরের চট্টগ্রাম ক্যাম্পাসে পরীক্ষামূলক চালনা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ল্যাবে উৎপাদিত হাইড্রোজেন ফুয়েল (জ্বালানি) দিয়েই গাড়িটি চালানো হয়। নিরবচ্ছিন্ন চলাচলের জন্য একটি ফুয়েল পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। নিত্য ব্যবহার্য বর্জ্যের সঙ্গে কাঠ ও বাঁশের গুঁড়া এবং পানি মিশিয়ে হাইড্রোজেন ফুয়েল উৎপাদন করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা কেন্দ্র।
বাংলাদেশের গবেষকরা বলেন, বর্তমানে এক লিটার জ্বালানি তেলে একটি প্রাইভেট কার ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে। কিন্তু এক কেজি হাইড্রোফুয়েলে একটি প্রাইভেট কার ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারবে। এই ফুয়েল বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহের জন্য আলাদা কোন হাইড্রোফুয়েল স্টেশন করতে হবে না। দেশে বিদ্যমান সিএনজি স্টেশনগুলোতে পৃথক একটি ইউনিট স্থাপন করলেই সেই ইউনিট থেকে হাইড্রোফুয়েল গাড়িতে সরবরাহ করা যাবে।
হাইড্রোজেনের ফুয়েলের আন্তর্জাতিক বাজার এবং সেটি কাজে লাগিয়ে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, কৃত্রিম পণ্য উৎপাদন বেড়েই চলেছে৷ বিশ্বে হাইড্রোজেনই একমাত্র উপাদান যা বিশ্বে ‘রেডি’ অবস্থায় পাওয়া যায়। হাইড্রোজেনের ফুয়েল জ্বালানীর নিখুঁত উৎস যা বিশ্বকে কার্বন মুক্ত করার চমৎকার সহায়ক হবে। ফলে হাইড্রোজেন প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে৷
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।