মো. লুৎফর রহমান : একাত্তরের ২৫ মার্চ। অস্থির দেশ। চারপাশে চাপা উত্তেজনা। ইপিআর সৈনিক আব্দুল মান্নান দায়িত্ব পালন করছিলেন পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চপড়ামারি সীমান্ত সেকশনে।
পাকিস্তানি অফিসারদের আচার আচরণে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসছিল বাঙালি সৈনিকেরা। ২৫ মার্চ সীমান্ত সেকশনের ভেতরে একটি বাঁশের মাচার ওপর বসে রেডিওতে খবর শুনছিলেন মান্নানসহ কয়েকজন সৈনিক। এই দৃশ্য দেখে এগিয়ে সেকশন কমান্ডার হাবিলদার মোঘলবাজ রেডিও বন্ধ করার নির্দেশ দেন। খবর শুনতে না দেওয়ায় এক পর্যায়ে রাগে ক্ষোভে তার মুখের ওপর রেডিও ছুঁড়ে মারেন মান্নান। এ সময় দুজনেই মারমুখী হলে সহকর্মীরা তাদের সরিয়ে নেন। পরে হাবিলদার বিষয়টি পঞ্চগড় কোম্পানি কমান্ডারকে অবহিত করেন। রাতেও তাদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
২৬ মার্চ সকালে ফলিং করছিলেন সৈনিকেরা। সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন হাবিলদার মোঘরবাজ। পাশে আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে আছে মান্নান। মান্নানের নজর ক্যাম্পের পাশের রাস্তার দিকে। বাইসাইকেল নিয়ে সেকশনের দিকে এগিয়ে আসছিলেন ডানাকাটা প্লাটুন কমান্ডার মতিয়ার রহমান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি কিছু একটা ইশারা করলেন। তাতে মান্নান বুঝলেন রাতে ভয়ানক কিছু হয়েছে। তারপর তিনি সকল সৈনিককে অস্ত্র বের করতে বললেন। অস্ত্র পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে কৌশলে মান্নানকে কাছে ডেকে নিয়ে ওই সেকশনে থাকা সব সৈনিককে হত্যা করার নির্দেশ দেন তিনি। অস্ত্র গুছিয়ে রাখার এক পর্যায়ে দুটি রাইফেলে গুলি ভরে করে আলাদা করে রেখে দেয় মান্নান। প্লাটুন কমান্ডার চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সুযোগ বুঝে ন্যান্স নায়েক শারাফাত ও মান্নান দুটি রাইফেল দিয়ে এক এক করে সব পাক সেনাদের গুলি করে হত্যা করেন। একজন পাক সেনা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন স্থানীয়রা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় সেকশন ঘিরে স্থানীয়রা জয় বাংলা বলে স্লোগান দিতে থাকে।
ক্যাম্পেই নিহন পাক সেনাদের সমাহিত করা হয়। বীর প্রতীক ন্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নান জানান, এই অপারেশনের মধ্য দিয়েই আমরা মূলত যুদ্ধ শুরু করি। আমাদের তেমন কোনো ভারি অস্ত্র ছিলো না। তবে দেশের জন্য ছিলো ভালোবাসা আর পাকিস্তানিদের জন্য ঘৃণা।
মান্নানের দেওয়া তথ্য মতে, এ ঘটনার পর প্রত্যেক সীমান্ত থেকে বাঙালি সৈনিকদের একত্র করে ১০ মাইল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিকসহ বেসামরিক যোদ্ধারাও যোগ দেন। শুরু হয় বাংকার খোড়ার কাজ। কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাংকার খোড়া হয়। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোনো একদিন সকাল বেলায় হঠাৎ বিশাল বাহিনী নিয়ে পাক সেনারা সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে দিনাজপুরের দিকে আসতে থাকে। তারা মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গোলা নিক্ষেপ করতে করতে সামনে এগিয়ে আসে। তাদের সাথে ট্যাংকসহ ছিল ভারি অস্ত্র। খুব অল্প সময়েই তারা দশমাইলের কাছাকাছি চলে আছে। দশমাইল এলাকায় পড়তে থাকে তাদের ছোড়া গোলা। এই দৃশ্য দেখে পিছু হটতে থাকে বাঙালি সেনারা।
হাজারো মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঠাকুরগাঁয়ের দিকে পালাতে থাকে। পিছু হটতে হটতে কান্তনগর এলাকায় পৌঁছানোর পর তিনি চিন্তা করেন এভাবে পালিয়ে কেউ বাঁচতে পারবে না। পাকসেনাদের একটি দল দিনাজপুর আরেকটি ঠাকুরগাঁয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা পালাতে থাকা হাজারো মানুষের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
মান্নান ভাবলেন মৃত্যু ছাড়া সামনে কোনো পথ খোলা নেই। তার মাথায় একটাই চিন্তা হাজারো মানুষকে বাঁচাতে হলে যেভাবেই হোক পাক সেনাদের থামাতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন প্রতিরোধ। তিনি হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। পেছনে কেউ নেই। সেনাবাহিনী ও ইপিআর থেকে পালিয়ে আসা সৈনিকেরাও প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে। সব শেষে পালাতে থাকা সেনাবাহিনীর গাড়ি চালক আব্দুস সাত্তার ও ইপিআর সৈনিক রহমানকে থামার অনুরোধ জানান মান্নান। কিন্তু তারা কথা না শুনায় তিনি রাইফেল তাক করে গুলি করার হুমকি দিলে তারা থামতে বাধ্য হন। পরে তাদের মান্নান বোঝাতে সক্ষম হন যে কোনোভাবেই বাঁচা সম্ভব নয়। তার চেয়ে উচিত হবে পাকিস্তানিদের যে কোনোভাবে থামানো। পরে ওই দুইজনকে নিয়ে একটি বাংকারে অবস্থান নেন মান্নান। বাইরে ফেলে যাওয়া বাঙালি সৈনিকদের অস্ত্র ও গুলি বাংকারে নিয়ে আসেন তারা। বাংকারের একটি ফাঁকা দিয়ে গুলি ভর্তি একটি এলএমজি রাইফেল তাক করে রাখেন।
এদিকে কোনো বাধা না পাওয়ায় পাক সেনারা নিশ্চিন্তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সকাল ১০ টায় পাক সেনারা তাদের পরিসীমার মধ্যে ঢুকে পড়লে ফায়ার ওপেন করেন মান্নান। কিছু বুঝে উঠার আগেই মান্নানের গুলিতে ধরাশায়ী হতে থাকে পাকসেনারা। রহমান আর সাত্তার দুজনে গুলি ভরে প্রস্তুত করে দিচ্ছেন আর মান্নান একাই ফায়ার করে চলেছেন। কিছুক্ষণ পর পাকসেনারাও পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করে। সকাল ১০টা থেকে বিরামহীনভাবে ফায়ার করে চলে মান্নান। পাকসেনা মান্নানের অবস্থান নিশ্চিত হলেও বাংকারটি টিলার মধ্যে হওয়ায় কিছুই করতে পারছিলেন না। সন্ধ্যার দিকে গুলি ফুড়িয়ে যায় মান্নানের। এ সময় বাইরে থেকে গুলি নিয়ে আসতে বাংকার থেকে বের হওয়া মাত্রই পাক সেনাদের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যায় সাত্তারের পুরো শরীর। চোখের সামনেই সাত্তারের মৃত্যু দেখলেও কিছুই করার ছিল না তাদের। সারাদিনে পেটে কোনো খাবার পড়েনি। এদিকে চারপাশে ঘিরে ফেলেছে পাক সেনারা। পাক কমান্ডারের নির্দেশে জবানবন্দি নেওয়ার জন্য মান্নান ও রহমানকে জীবিত আটক করা হয়। পরে তাদের চোখ ও হাত বেধে সৈয়দপুর সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে কৌশল খাটিয়ে মান্নান তাদের জানান যে, ‘আমরা মনে করেছি পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এরা ভারতীয় সৈন্য ভেবে আমি গুলি করেছি। ’
সেখানে দিনের বেলায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ আর রাতে চলত অমানবিক নির্যাতন। দুই মাস তাদের আটকে রাখার পর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় রংপুর সেনানিবাসে। সেখানে আরো কিছুদিন নির্যাতন চলার পর একদিন তাদের হাত চোখ বেঁধে রংপুর উপশহরের ক্ষণিরদিঘীতে নিয়ে যাওয়া হয় হত্যা করার জন্য। সেখানে তারাসহ ছিলেন ২০ থেকে ২২ জন বাঙালি। পেছন দিক থেকে এক এক করে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে তাদের। একজন পাকসেনাই গুলি করছেন। বাম থেকে গুলি করা শুরু হয়েছে। এক পর্যায়ে মান্নানের পাশে থাকা রহমানকেও গুলি করা হয়। রহমান সাথে সাথেই মারা যায়। এরপর মান্নানকে গুলি করার সময় মান্নান একটু নিচু হলে গুলিটি তার পিঠ ভেদ করে কাধের নিচ দিয়ে বেড়িয়ে যায়। জখম হলেও মান্নান পড়ে গিয়ে মরার ভান করেন। ঠিক এই সময় বৃষ্টি শুরু হলে পাকসেনারা লাশগুলো ওভাবে রেখেই চলে যান। কিছু সময় অজ্ঞান থাকার পর মান্নান চেতন ফিরলে নিজে উঠেই স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে পৌছান ভারতের তরঙ্গপুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মেজর রউফের কাছে।
মান্নানকে দেখে তারা বিস্মিত হন। সবাই জানতেন মান্নান নিহত হয়েছে। পরে সুবেদার মেজর রউফ তেঁতুলিয়ায় থাকা সুবেদার মেজর কাজিম উদ্দিনকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে কাজিম উদ্দিন মান্নানকে চিকিৎসার জন্য ভারতের কল্যাণী হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে বাগডোগরা ও লখনৌ হাসপাতালে চিকিৎসার পর দেশে ফিরেন মান্নান। তখন দেশ স্বাধীন। দেশে ফিরে মান্নান যোগ দেন বাংলাদেশ রাইফেলসে। সেদিন মান্নান প্রতিরোধ গড়ে তোলায় বেঁচে যায় হাজারো মানুষ। হতাহত হয় শতাধিক পাক সেনা। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন।
বীর প্রতীক আব্দুল মান্নান বলেন, পাকিস্তানি শাসকরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অনেক আগে থেকেই। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আগে পশ্চিম পাকিস্তানি থেকে অসংখ্য সৈনিক ও অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু আমরা তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তাদের নির্যাতন আর নির্মমতা আমাদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তারা বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের খবর পর্যন্ত শুনতে দিতো না। সেদিন আমি জানতাম আমার সামনে মরণ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। পালিয়ে বেশি দূর যেতে পারব না। ছুটতে থাকা হাজারো মানুষ কেউ বাঁচতে পারবে না। খুব কাছে চলে এসেছে পাক সেনাদের বহর। কমপক্ষে ৫ থেকে ৬’শ পাক সেনা আর তাদের ট্যাংকসহ ভারি ভারি অস্ত্র। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসছে তারা। আমার কেবল মনে হয়েছে এই মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে। তাই একাই প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্র তুলে নেই। তারা আমাদের ধরে নিয়ে গিয়ে কি যে নির্যাতন করেছে তা বর্ণনা করার মতো নয়। আমাকে হত্যার জন্য গুলিও করেছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমি বেঁচে যাই। আমরা খেতাব কিংবা অর্থ কোনকিছুর জন্যে যুদ্ধ করিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিলো দেশকে শত্রুমুক্ত করা। আমরা আগামীর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়বে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বীর প্রতীক আব্দুল মান্নানের জন্ম নোয়াখালী জেলার কম্পানিগঞ্জ থানার মোহাম্মদনগর এলাকায়। তিনি ওই এলাকার সফি উল্লাহর ছেলে। নোয়াখালীতে জন্ম হলেও মুক্তিযুদ্ধের পর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বিয়ে করে স্ত্রী সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন জাতির সূর্য সন্তান। সূত্র : কালের কন্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।