নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ। সরকার পতনের পর তার থেকে এই প্রভাবশালী কর্মকর্তার হদিস নেই। হারুনের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে ভুক্তভোগীসহ অনেকে। টানা চার বছর গাজীপুর জেলায় এসপি থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। টাকার জন্য এমন কিছু নেই যা তিনি করেননি। সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও বোকা বানিয়েছেন। তার অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি সাংবাদিকরাও।
২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর। গাজীপুর পৌর সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলার মুক্ত সংবাদ পত্রিকার অফিস থেকে ডিবি পুলিশের সদস্যরা জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক মো. সোহরাব হোসেনকে। তিনি ছোটবেলা থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধি।
যারা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন তাকে নেওয়া হচ্ছে। ডিবির সদস্যরা জবাব দেন এসপি হারুনের নির্দেশে তাকে নেওয়া হচ্ছে।
দৈনিক মুক্ত সংবাদের নির্বাহী সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রায়হান বলেন, ‘‘২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর দুপুরে বাসা থেকে বাবার জন্য অফিসে খাবার নিয়ে আসি। অফিসে আসার পর জানতে পারি, বাবাকে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়েছে। আমার বাবা একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তাকে যেভাবে নিজ কার্যালয় থেকে ডিবি পুলিশ দিয়ে জোরপূর্বক উঠিয়ে নেওয়া হলো, তা অকল্পনীয়।
‘কেনো, কী কারণে পুলিশ নিয়ে গেলো তা আমরা জানতে পারলাম না। বিকেলে শুনি একটা মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমার বাবার অপরাধ ছিল একজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তথ্যবহুল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তার নিজ পত্রিকায় প্রকাশ করা। এই অপরাধে তাকে কোনো মামলা ছাড়াই কেনো উঠিয়ে নিয়ে গেলো, এর বিচার হওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, ১৭ দিন জেল খাটার পর ২১ নভেম্বর জামিন হয়। সেদিন কারাগারের ভিতর থেকে আবারও ডিবি পুলিশ দিয়ে উঠানো হয়। এ সব কিছুই বর্তমান সাবেক ডিবি প্রধান ও গাজীপুরের এসপি হারুনের নির্দেশে হয়েছিল।”
অপর একজন সাংবাদিক মো. আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। তিন দশক ধরে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৯ সালের ২ মে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা। ‘বাংলাভূমি’ অফিসে বসে কাজ করছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। হঠাৎই প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য দিবে বলে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করেন। এরপর দেখা করতে গেলে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান ফটকের সামনে থেকে এসপি হারুনের নির্দেশে সাদা পোশাকে থাকা কয়েকজন ব্যক্তি হায়েস গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ২০ দিন পর পরিবার তার সন্ধান পায়।
পরে পরিবার জানতে পারে সাংবাদিক লতিফকে ৫০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান করা হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী প্রায় ৯ মাস জেল খেটেছেন। এরপর রিমান্ডে নিয়ে এবং জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তিনটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়। মামলা চালাতে গিয়ে লতিফ সিদ্দিকী এখন নিঃস্ব। এমনকি অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে তার সন্তানদের লেখাপড়াও।
‘মুক্ত বলাকা’ নামে পত্রিকায় ২০১৭ সালে একটি নিউজ হয়। নিউজটি হারুনের বিপক্ষে যাওয়ার পরেরদিন রাতে ২০০ পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করা হয় ওই পত্রিকার সম্পাদক আলমগীর হোসেনের বাড়ি। সেদিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। পরে তার বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি চালানো ও ভাঙচুর করা হয়। এরপর তিনি ৩ মাস আর গাজীপুরে ফিরতে পারেননি।
‘মুক্ত বলাকা’র সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘একটি নিউজ প্রকাশ করেছিলাম যে নিউজটা তৎকালীন এসপি হারুনের পছন্দ হয়নি। নিউজ প্রকাশের পরেরদিন শুক্রবার রাতে আমাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও তুলে নেওয়ার জন্য ২০০ পুলিশ নিয়ে আমার বাড়ি ঘেরাও করেন। ওইদিন আমি পারিবারিক কাজে বাগেরহাট গিয়েছিলাম বলে আমাকে পায়নি। তবে বাড়িতে ভাঙচুর করে এবং আমাকে গাজীপুর আসতে মানা করে। পরে হারুনের কারণে তিন মাস আমি পালিয়ে বেড়াই।’
শুধু সাংবাদিক নয়, বিরোধীদলীয় নেতা, সরকার দলীয় নেতা, ব্যবসায়ী ও ধনীর সন্তানরা ছিল হারুনের টার্গেট। মূলত হারুন গাজীপুরের এসপি থাকাকালীন তার সমস্ত অপকর্ম করতেন ডিবি দিয়ে। সেসময় তিনি ডিবির ১৩-১৪টি দল গঠন করেছিলেন। সেময় ডিবি গাজীপুরের আতঙ্কের নাম ছিল। থানাগুলো ছিল নামে মাত্র। সব কার্যক্রম চালাতো হারুনের ডিবি টিম।
স্থানীয় ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসপি হারুনের নির্দেশে প্রতি রাতে ডিবির একাধিক দল নেমে পড়তো টার্গেট-কৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে। গাড়িতে মজুত রাখা হতো ইয়াবা, অস্ত্র ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। সুযোগ বুঝে ওইসব জিনিস দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হতো নিরপরাধ ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও ধনী পরিবারের সন্তানদের। দিনে হারুনের নেতৃত্বে পরিকল্পনা হতো, রাতে হতো অধিকাংশ অভিযান।
গাজীপুরে এসপি হারুনের চার বছরের রাজত্বে মাদক, আবাসিক হোটেলে দেহ ব্যবসা ও জুয়ার জমজমাট ব্যবসা চলে। আর এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। হারুন আসার আগে গাজীপুরের কোথাও হোটেলে দেহ ব্যবসা ছিল না। তার আমলে গড়ে ওঠে কয়েকশ’ আবাসিক দেহ ব্যবসার আস্তানা। এসব আস্তানা ও জুয়ার আসর থেকে ক্যাশিয়ার হিসেবে টাকা তুলতেন তৎকালীন ডিবি ও সদর থানা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। যাদের অনেকেই এখনো গাজীপুরে রয়েছেন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নেপথ্যেও হারুনের ইন্ধন ছিল। জেলার শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা করা হয়েছে। মামলা আর হামলার ভয়ে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া হয়েছেন। মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের পৃথক অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে বরখাস্ত করার পেছনে তার অবদান রয়েছেন।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, চান্দনা এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরে যাওয়ার কথা প্রথমে পুলিশ স্বীকার করে। কিন্তু পরে নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে মামলা দেওয়া হয়। অথচ আগুন লাগার অন্তত পাঁচ ঘণ্টা আগে মান্নানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন হারুন এতটাই বেপরোয়া হয় উঠেছিলেন যে, টাকা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। টাকা না দিলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদেরও হেনস্থা করতেন।
কালিয়াকৈরের যুবলীগ নেতা রফিক হত্যার পর ডিবির উৎপাতে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা, পল্লীবিদ্যুৎ, হরিণহাটিসহ আশপাশের এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। শতাধিক লোককে ডিবি আটক করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এক ব্যক্তিকে দুই থেকে তিনবার আটক করার ঘটনাও ঘটেছে। ওই সময়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মুচি জসিমকে দিয়ে কাজ করতেন হারুন। পরবর্তীতে হারুন গাজীপুরের এসপি পদ ছাড়লে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মুচি জসিম।
সফিপুর বাজার ব্যবসায়ী মোতালেব বলেন, ‘হারুন ডিবি দিয়ে তুলে নিয়ে চার দিন নির্যাতন করে। আমার হাতের পাঁচটি নখ তুলে ফেলে। পরে এক কোটি টাকা দিলে মুক্তি দেওয়া হবে বলে জানায়। আমার এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তবুও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ছয় লাখ টাকা নগদ ও ছয় লাখ টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করি। আমাদের বাজারের রট সিমেন্টের ব্যবসায়ী আজিজ সাহেবকে ডিবি দিয়ে তুলে নিয়ে অর্ধকোটি টাকা আদায় করে হারুন।’
মাধবপুর এলাকার ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়া স্বত্বেও হারুন আমাদের হয়রানি করেছে। তবে আমি ভয় পাইনি, কোনো টাকা পয়সাও দেইনি। জমিজমার বিষয়ে হারুনের হস্তক্ষেপ তোয়াক্কা না করে প্রতিবাদ করেছি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।