কিছুদিন আগে পৃথিবীজুড়েই হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল এক বিশেষ প্রচারাভিযানকে কেন্দ্র করে। ‘নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন’ নামের এক সংস্থা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন করবে ভোটাভুটির মাধ্যমে। এর আগে সংস্থাটি ২০০৭ সালে ‘পৃথিবীর নতুন সপ্তাশ্চর্য’ নির্ণয়ের মাধ্যমে আলোচনায় এসেছে। বাঙালিকে আমরা হুজুগে জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও হুজুগ নামক বস্তুটা যে দুনিয়ার অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেও প্রবলভাবে বিদ্যমান, সেটা তখন বুঝতে পেরেছিলাম ভালোভাবেই।
লোকজন নিজেদের দেশের নির্দিষ্ট স্থানকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসে উঠেপড়ে লেগেছিল। অনেক দেশে সরকারিভাবেই প্রচারণা চলেছিল জোরেশোরেই। যদিও এভাবে ভোটাভুটির মাধ্যমে কোনো স্থান নির্ণয় নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক উঠেছিল। আজকের দিনে আমি নিজেও এ ধরনের প্রচারণার বিরোধী। পৃথিবীর সব স্থান তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য। কোনটা শ্রেষ্ঠ—তা নিয়ে ভোটাভুটি অর্থহীন।
৪৪০টি স্থানের প্রাথমিক তালিকা থেকে ধাপে ধাপে ২৮টি স্থান চূড়ান্তভাবে ভোটাভুটির জন্য নির্বাচন করা হয়। তালিকায় বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছিল সুন্দরবন। পৃথিবীব্যাপী যে দশ কোটি হুজুগে মানুষ এই তালিকা চূড়ান্তকরণে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই অধম বাংলাদেশিও ছিল। যদিও আমার ভোট কাজে লাগেনি। সুন্দরবন শেষ পর্যন্ত তালিকা থেকে বাদ যায়। যেই সাতটি স্থান চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়, সেটির অন্যতম ছিল ভিয়েতনামের হা লং উপসাগর।
সেই প্রথম আমার হা লং উপসাগরের নাম শোনা। সেই প্রথম আমার হা লং উপসাগরে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে স্বপ্নের জাল বোনা। তাই জাহাজের ডেকে বসে হা লং উপসাগরের নিস্তরঙ্গ পান্না সবুজ জলে মাথা বের করে রাখা ক্ষুদ্র্র দ্বীপগুলোকে যখন পাশ কাটাচ্ছি, তখন স্বপ্ন পূরণের একটা অনুভব মনের মধ্যে তীব্রভাবে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। এসব ছোট ছোট মুহূর্তের জন্যই তো আমরা বেঁচে থাকি। ভিয়েতনামের একদম উত্তর সীমান্তে কোয়াং নিন প্রদেশে হা লং বের অবস্থান। খুব কাছেই চীনের গোয়াংজি প্রদেশ। ছয় শ বর্গমাইল আয়তনের উপসাগরটিতে প্রায় দুই হাজার ছোট ছোট দ্বীপ আছে, যেগুলোর বেশির ভাগই জনমানবহীন।
১৯৯৪ সালে ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। হ্যানয় থেকে প্রায় দুই শ কিলোমিটার দূরত্বের এই স্থানটি ঘোরার জন্য বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির এক বা দুই দিনের প্যাকেজ পাওয়া যায়। এক দিনের এমনই এক প্যাকেজ দেশ থেকেই ঠিক করে গিয়েছিলাম। সাতসকালেই একজন প্রদর্শক গাড়ি নিয়ে হোটেলের নিচে হাজির। প্রথমে বাসে করে যেতে হবে হা লং শহরের জাহাজঘাটে।
সেখান থেকে জাহাজে করে সারা দিন ঘুরিয়ে বিকেলে ঘাটে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। এরপর আবারও বাসে করে হ্যানয়ে ফেরতযাত্রা। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। বাইরে গরম থাকলেও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসের ভেতরটা বেশ আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সুপ্রশস্ত এবং মসৃণ চার লেনের সড়কের এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে আবাদযোগ্য জমিতে ধানখেতের সমারোহ। উত্তরে রেড রিভার আর দক্ষিণে মেকং ডেল্টা পুরো ভিয়েতনামকে উপহার দিয়েছে উর্বর ভূমি।
ভিয়েতনাম পৃথিবীর অন্যতম ধান উৎপাদনকারী দেশ। বাঙালিদের মতোই এখানকার লোকজনেরও প্রধান খাদ্য ভাত। সেই সঙ্গে সালাদ এবং নুডলসও চলে। সবুজ প্রকৃতি চোখের জন্য যথেষ্ট আরামদায়ক। কোন দিক দিয়ে যে সময় কেটে যায়, তা বোঝাই যায় না। ঘণ্টা দেড়েক পার হওয়ার পর দশ মিনিটের যাত্রাবিরতি দেওয়া হলো ‘লিজেন্ড পার্ল’ নামক মুক্তার দোকানে। মুক্তার অলংকার কেনা ছাড়াও এখানে মুক্তা উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটি দেখানো হয়।
প্রথমে একটি ঝিনুকের ভেতর বীজ বা নিউক্লিয়াস ঢোকানো হয়। বহিরাগত বস্তু থেকে সুরক্ষার জন্য বীজটির চারপাশে ঝিনুকের খোলস থেকে এক প্রকার আবরণী পদার্থের নিঃসরণ ঘটে। এরপর ঝিনুকটিকে সমুদ্রের পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। সমুদ্রের তাপমাত্রা এবং চাপের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট সময় পর বীজটি মুক্তায় পরিণত হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়।
একটা ঝিনুক থেকে সর্বোচ্চ বিশ থেকে চল্লিশটি মুক্তা পাওয়া গেলেও শতকরা মাত্র পাঁচ ভাগ কাজে লাগানো যায়। সব মুক্তা সুন্দর আকৃতির হয় না, আবার সব ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়া যায় না। এ জন্যই মুক্তার অলংকার এত দামি। মুক্তার দোকানটিতে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগছিল। ভিয়েতনামের পথে ঘাটে মুক্তার অলংকার পাওয়া যায়, তবে বেশির ভাগই নকল। এখানে আসল মুক্তা পাওয়া গেলেও সেগুলোর দাম শুনে ভিরমি খেতে হয়। হা লং জাহাজঘাটে পৌঁছে দেখি শত শত জাহাজ এবং রংচঙে নৌকা জায়গাটার শোভাবর্ধন করছে। আমাদের জন্য বরাদ্দ করা জাহাজটির নাম স্টেলা লাক্সারি ক্রুজ।
বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা এসেছেন ঘোরার প্রয়াসে। সম্ভবত আমরাই শেষ দল ছিলাম। জাহাজে উঠতে না উঠতেই জাহাজ চলা শুরু করল। ঘড়িতে স্থানীয় সময় সকাল এগারোটা তিরিশ। ছয় ঘণ্টার এই নৌবিহার আমাদের কোথায় কোথায় নিয়ে যায় দেখা যাক। জাহাজের ভেতরটা আরামদায়ক হলেও ডেকে রোদচশমা ছাড়া হাঁটাই মুশকিল। সবুজ জলে রোদগুলো প্রতিফলিত হয়ে অসীমে হারিয়ে যাচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।