প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে বিভ্রান্তিমূলক হিসেবে অভিহিত করে নিজের গবেষণায় এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ ‘নিরুদ্দিষ্ট’ হওয়ার তথ্য তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত।
প্রিয়া সাহা গত শনিবার এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তার তথ্যের সঙ্গে আবুল বারকাতের গবেষণা তথ্যের সাদৃশ্য থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এর প্রেক্ষিতে আবুল বারকাত আজ সোমবার এক বিবৃতিতে জানান, আমার হিসেবে প্রায় পাঁচ দশকে (১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত) আনুমানিক এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন (উৎস: আবুল বারকাত, ২০১৬, বাংলাদেশ কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পৃষ্ঠা ৭১)। অর্থাৎ আমি কোথাও ‘তিন কোটি ৭০ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন’ এ কথা বলিনি। উপরন্তু তিনি কোথাও বললেন না যে আমার গবেষণা তথ্যটির সময়কাল ৫০ বছর ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত।
‘হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট’ হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আবুল বারকাত দাবি করেন, ২০১১ সালে সরকারি আদমশুমারির তথ্যের ভিত্তিতে ১৯০১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার উল্লেখ করেছি মাত্র।
অন্যদিকে প্রিয়া সাহা গত রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু ‘ডিসঅ্যাপিয়ার্ড’ হওয়ার কথা বলেছেন। ‘ডিসঅ্যাপিয়ার্ড’ বলতে তিনি ‘ক্রমাগতভাবে হারিয়ে যাওয়া’ বুঝিয়েছেন।
প্রিয়া সাহার দাবি, ‘সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে এ দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৯ দশমিক সাত শতাংশ। ২০১১ সালের জরিপে তা নেমে এলো নয় দশমিক ছয় শতাংশে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৮ কোটি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে তো এখন সংখ্যালঘুর সংখ্যা ছয় কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে সংখ্যালঘুর সংখ্যা এক কোটি ২৯ লাখ। অর্থাৎ চার কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার হওয়ার লোক ক্রমাগতভাবে হারিয়ে গেলো। আমি ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সাল হিসাব ধরে তিন কোটি ৭০ লাখ ক্রমাগতভাবে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি।
ভিডিও সাক্ষাৎকারে প্রিয়া সাহা অধ্যাপক আবুল বারকাতের সঙ্গে ‘সরাসরি’ কাজ করেছেন বলে দাবি করেছেন। তবে তা নাকচ করে আবুল বারকাত বলেছেন, প্রিয়া সাহা কখনও তার সহগবেষক, গবেষণা সহকারী অথবা গবেষণা সহযোগী ছিলেন না। এজন্য তিনি প্রিয়া সাহাকে বিভ্রান্তিমূলক ও নীতি গর্হিত বক্তব্য প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
আবুল বারকাত প্রিয়া সাহা প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি এও বলেছেন যে ‘বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৬৩২ জন লোক হারিয়ে যাচ্ছে।’ আবুল বারকাত বিবৃতির পরের অংশে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করেননি। তবে ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণবিজ্ঞান অনুষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের কৃষি-ভূমি-জলা জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক আঞ্চলিক সেমিনারের জন্য আবুল বারকাত রচিত ‘বাংলাদেশ কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য রয়েছে।
তিনি সেখানে লিখেছেন, প্রধানত শত্র সম্পত্তি আইন বলবৎ করা এবং সংশ্লিষ্ট সাম্প্রদায়িক সংঘাত-সংঘর্ষসহ বহু ধরনের বঞ্চনা-বিপর্যয়ের কারণে এবং পরবর্তীতে ওই একই আইন ভিন্ন নামে (অর্পিত সম্পত্তি নামে) কার্যকর থাকার ফলে ব্যাপকসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ অনিচ্ছায় দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ‘নিরুদ্দিষ্ট হিন্দু জনসংখ্যা’ (মিসিং হিন্দু পপুলেশন)।
১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক লাখ হিন্দুধর্মাবলম্বী মানষ নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার তথ্য তুলে ধরে আবুল বারকাত লিখেছেন, গড়ে বছরে বাধ্য হয়ে দেশান্তরিত হয়েছেন আনমানিক দুই লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। অন্য কথায়, শত্র/অর্পিত সম্পত্তি আইন-উদ্ভত বঞ্চনার মাত্রা এমনই যে ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দ ধর্মাবলম্বী মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
আবুল বারকাত আরো লিখেছেন, বিভিন্ন সময়কালে প্রতিদিন গড়ে নিরুদ্দিষ্ট হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানষের সংখ্যা সমান নয়: যেমন ১৯৬৪-১৯৭১ (পাকিস্তানের শেষ সাত বছর) সময়কালে প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৭০৫ জন, ১৯৭১-১৯৮১-এ প্রতিদিন ৫২১ জন, ১৯৮১-১৯৯১-এ প্রতিদিন ৪৩৮ জন, ১৯৯১-২০০১-এ প্রতিদিন ৭৬৭ জন, আর ২০০১-২০১২-এ প্রতিদিন ৬৭৪ জন।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, ‘শত্র/অর্পিত সম্পত্তি আইন-উদ্ভুত এ নিরুদ্দেশ প্রক্রিয়ার প্রবণতা বজায় থাকলে এখন থেকে দু’তিন দশক পরে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো মানষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনুষ্য বঞ্চনার এর চেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ আর কি হতে পারে?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।