বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে নানা সংকটে জর্জরিত, যার একটি প্রধান ও অদৃশ্য কারণ হচ্ছে হুন্ডি (Informal Money Transfer)। এটি একটি অবৈধ অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়া যা প্রবাসীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে ব্যবহৃত হয়। বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল এড়িয়ে এই পদ্ধতিতে অর্থ লেনদেনের ফলে রাষ্ট্র হারায় রাজস্ব, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পড়ে চাপ, এবং ক্রমশ বাড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হুন্ডি দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করার দাবি উঠেছে সকল মহল থেকে।
হুন্ডি কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে
হুন্ডি হলো একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ও অবৈধ আর্থিক লেনদেন পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের ব্যাংক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। প্রবাসী ব্যক্তি যখন নিজের উপার্জিত অর্থ হুন্ডি এজেন্টের মাধ্যমে দেশে পাঠান, তখন সেই অর্থ দেশে পৌঁছালেও তা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিমালার আওতায় আসে না। সাধারণত প্রবাসী দেশ থেকে টাকা দেন হুন্ডি ব্যবসায়ীকে, আর দেশে তাদের পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় মুদ্রায় সেই টাকা গ্রহণ করেন হুন্ডি এজেন্টের কাছ থেকে। এই লেনদেন হয় ক্যাশ-অন-ক্যাশ ভিত্তিতে, কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল বা কাগজপত্র ছাড়াই।
Table of Contents
এই প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার, সন্ত্রাসী অর্থায়ন, চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসীরা হুন্ডি ব্যবহার করে দেশে টাকা পাঠান কারণ সেখানে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে ডলারের বিনিময় হার বেশি পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থায় সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সরাসরি প্রভাব পড়ে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে হুন্ডির নেতিবাচক প্রভাব
হুন্ডির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহু বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার কোনো রাজস্ব পায় না এই চ্যানেলের মাধ্যমে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স থেকে। ফলে বাজেট ঘাটতি বাড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন সংকটে পড়ে। শুধু তাই নয়, এই অর্থ ব্যবহৃত হয় মাদক পাচার, মানব পাচার, অস্ত্র ক্রয়, চোরাচালানসহ নানা অপরাধে। হুন্ডির মাধ্যমে আয়কৃত অর্থ কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ব্যবহৃত হয়, যা দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হুন্ডির মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ৯১ হাজার কোটি টাকার সোনা ও হীরা চোরাচালান হচ্ছে বাংলাদেশে। এই বিপুল অর্থ পাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ডলার সংকটে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, বিশেষ করে জ্বালানি খাতে। এর ফলে দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ছে।
সোনা ও হীরা চোরাচালানের সঙ্গে হুন্ডির যোগসূত্র
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) জানিয়েছে, হুন্ডির মাধ্যমে প্রতিদিন দেশে ঢুকছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার অবৈধ সোনা ও হীরা। এর মধ্যে ২২০ কোটি টাকার সোনা এবং ৩০ কোটি টাকার হীরা প্রতিদিন চোরাচালানের মাধ্যমে আসছে। এর বার্ষিক হিসাব দাঁড়ায় প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমেই পাচার হচ্ছে, যার ফলে সরকার বৈধ রেমিট্যান্স হারাচ্ছে।
চোরাচালানকারীরা দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা যেমন চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা ইত্যাদি ব্যবহার করে এসব মূল্যবান ধাতু ভারতসহ অন্যান্য দেশে পাচার করে। এতে শুধু দেশের রিজার্ভই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
সরকারি পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ
হুন্ডি বন্ধে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা এখনও পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও নজরদারি বাড়ালেও বাস্তব কার্যকারিতা সীমিত। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় হুন্ডি ব্যবসা চলছেই।
বাজুসের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সোনা ও হীরা চোরাচালানে জড়িতদের ধরতে চিরুনি অভিযান এবং পৃথক মনিটরিং সেল গঠন জরুরি। ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার বন্ধ, সোনা-হীরা আসার বৈধ উৎস খতিয়ে দেখা এবং বৈধ কাগজপত্র পরীক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি সোনা চোরাচালানে ব্যবহৃত আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট ও স্থানীয় চক্রদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে হুন্ডির প্রভাব ও প্রতিকার
সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, হুন্ডিতে ডলারের বাড়তি দর পাওয়া যায় বলেই প্রবাসীরা বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডি ব্যবস্থায় আগ্রহী হন। এর ফলে দেশের রাজস্ব হারায় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তিনি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (BFIU) হুন্ডি সিন্ডিকেট শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম. মাশরুর রিয়াজ বলেন, হুন্ডি বন্ধে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের রেট প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। প্রবাসীদের টাকা দ্রুত ও সহজে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলেই হুন্ডি কমবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে হুন্ডি এবং চোরাচালান রোধে সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য।
সোনা ও হীরার শুল্কনীতির অসঙ্গতি
বাংলাদেশে সোনা ও হীরা আমদানির শুল্ক অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী বৈধ পথে না গিয়ে অবৈধ পথেই পণ্য আনেন। উদাহরণস্বরূপ, মসৃণ হীরার উপর ১৫১ শতাংশ এবং অমসৃণ হীরার উপর ৮৯ শতাংশ কর আরোপিত হওয়ায় তা আমদানিতে নিরুৎসাহিত করে। ফলে এই বাজার পুরোপুরি চোরাচালাননির্ভর হয়ে উঠেছে।
গত ১৯ বছরে হীরা আমদানিতে সরকার মাত্র ১২ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে, যেখানে দেশের হীরার বাজার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। হীরা চোরাচালানের খবর না পাওয়া ও তথ্য লুকিয়ে থাকা রহস্যজনক বলে মনে করছেন বাজুস।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা ও আইনি ফাঁক
আইন অনুযায়ী হুন্ডি ও সোনা চোরাচালান মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় পড়ে, যেখানে সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অপরাধের মূল হোতা ধরা পড়ে না, বরং গ্রেফতার হয় চুনোপুঁটি। অনেক সময় জামিন পেয়ে তারা পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সারা দেশে ২,৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করলেও মামলার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
হুন্ডি বন্ধে করণীয়
১. প্রবাসীদের জন্য বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ, দ্রুত ও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে।
২. হুন্ডি সিন্ডিকেট ও চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারি ও চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
৩. বাজুসের মতো সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে।
৪. সোনা ও হীরা আমদানির শুল্ক কাঠামো বাস্তবসম্মত করতে হবে যাতে বৈধ আমদানিতে উৎসাহ পাওয়া যায়।
৫. হুন্ডি ও চোরাচালানে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
হুন্ডি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অদৃশ্য কিন্তু ভয়াবহ হুমকি। এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, রাজস্ব ঘাটতি, চোরাচালান এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির প্রধান কারণ। এই সমস্যা নিরসনে সরকার, প্রবাসী এবং সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজতর করা এবং হুন্ডি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও স্থিতিশীল হতে পারবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।