চাঁদ প্রতি ২৯.৫ দিনে একবার সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে চলে আসে। তার মানে, প্রতি ২৯.৫ দিনে সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ এক সরলরেখায় থাকলে তো চন্দ্রগ্রহণ হওয়ার কথা, তাই না? কিন্তু আমরা জানি, বাস্তবে এমনটা হয় না। প্রশ্ন হলো, কেন? কিংবা প্রতি ২৯.৫ দিনে অমাবস্যার সময় কেন সূর্যগ্রহণ হয় না? চাঁদের ছায়া পৃথিবীর ওপরেই-বা পড়ে না কেন? রহস্যটা এখানেই।
সূর্যকে পৃথিবীটা যে সমতলে প্রদক্ষিণ করে, সেটাকে বাংলায় বলে অয়ন বৃত্ত। চাঁদ কিন্তু সেই একই সমতলে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না। চাঁদের কক্ষপথ সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর অয়নবৃত্তের সঙ্গে পাঁচ ডিগ্রি কোণ করে আছে। এই পাঁচ ডিগ্রি পার্থক্যের জন্য চাঁদ সবসময় পৃথিবী ও সূর্যের সঙ্গে এক সরলরেখায় থাকে না।
পৃথিবী থেকে দেখলে—চাঁদ কখনো সূর্যের নিচে, আবার কখনো সূর্যের ওপরে থাকে। একপাক ঘুরে আসার সময় চাঁদের কক্ষপথ অয়নবৃত্তকে দুবার ছেদ করে। এই ছেদবিন্দুগুলোকে বলা হয় চন্দ্রযোগ। আর এই চন্দ্রযোগের সময় সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ চলে আসে এক সরলরেখায়। শুধু এ সময়ই হতে পারে গ্রহণ। অর্থাৎ এই ঘটনা বা মহাকর্ষীয় রেখায় আসার ঘটনা ঘটে বছরে দুই বারের মতো।
সূর্যের ব্যাস চাঁদের ব্যাসের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বড়। আবার পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের প্রায় ৪০০ গুণ। তাই আমাদের চোখে চাঁদ আর সূর্যের আকার একই মনে হয়। চাঁদের কক্ষপথ বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। এই কক্ষপথে চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকে, তাকে বলা হয় অনুভূ (Perigee)। আর যখন সবচাইতে দূরে থাকে, তাকে বলা হয় অপভূ (Apogee)। এই দূরত্বের কম বেশির জন্যই আমরা কখনো চাঁদকে বড় দেখি, আর কখনো ছোট দেখি। এই ছোট-বড় হওয়ার পরিমান প্রায় ১৪ শতাংশ।
সূর্যগ্রহণ কেমন হবে, সেটার সঙ্গে চাঁদের এই আকারের সম্পর্ক নিগূঢ়। একই সমতলে না থাকার ফলে চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে না দিয়ে সূর্যের তলের আংশিক নিচ বা ওপর দিয়ে যেতে পারে। ফলে তখন চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী এক রেখায় থাকলেও গ্রহণ হয় না।
আবার যদি একই সমতলে থাকে—কিন্তু চাঁদ যদি ছোট থাকে, তাহলে সেটা সূর্যকে পুরোপুরি ঢাকতে পারে না। ফলে তখন গ্রহণ হলেও চাঁদের চারপাশ থেকে সূর্যের খানিকটা রশ্মি বেরিয়ে আসে। পৃথিবী থেকে এই আলোকে আংটির মতো দেখায়। এর নাম বলয় গ্রাস।
আর চাঁদ যদি অনুভূতে থাকে, তাহলে চাঁদকে পৃথিবী থেকে বড় দেখায়। এটা সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে। তাই একে বলা হয় পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। এই গ্রহণ দেখতে হলে আমাদেরকে পৃথিবীর সঠিক স্থানে থাকতে হবে। আলোর গতিপথে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু থাকলে বস্তুটির পেছনের অন্ধকারছন্ন অঞ্চলটিকে ছায়া বা প্রচ্ছায়া বলা হয়।
প্রচ্ছায়ার চারপাশে একটি কম অন্ধকারাছন্ন স্থান থাকে, যেখানে আলোক উৎসের কিছু অংশ থেকে আলো পৌঁছায়। এই কম অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলটিকে বলে উপচ্ছায়া। এর বাইরে সূর্যকে আর দেখা যায় না। সূর্যগ্রহণ খুবই ক্ষণস্থায়ী। খুব বেশি হলে সাত মিনিট দেখা যায়।
চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়ার আকার বেশ বড় হলে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময়কাল বড় হয়। এ সময় পৃথিবীর একটা বড় অংশ থেকে দেখা যায় পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। চন্দ্রগ্রহণও কিন্তু অনেকটা সূর্যগ্রহণের মতো। তবে এক্ষেত্রে চাঁদ ঢাকা পড়ে পৃথিবীর ছায়ায়। অর্থাৎ পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের মাঝখানে থাকার ফলে চাঁদে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না।
পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে এ সময় রাত থাকে, সেসব অঞ্চল থেকেই এই গ্রহণ দেখা যায়। এই গ্রহণ কয়েক ঘন্টাও হতে পারে। ২০২১ সালের নভেম্বরের ১৯ তারিখ ছিল এরকম একটি বিশেষ দিন। সেদিন প্রায় ৬০০ বছরের দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল। এর স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা।
তবে পূর্ণ গ্রহণের সময়ও কখনো কখনো সূর্যের আলোর কিছুটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতিসরিত হয়ে চাঁদে পড়তে পারে। এ সময় চাঁদকে লালচে দেখায়। আমরা যাকে বলি ব্লাডমুন।
চাঁদ পৃথিবী থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এই দূরত্ব যত বাড়বে, চাঁদের ছায়া ও আকারও তত ছোট হতে থাকবে। ধারণা করা হয়, আজ থেকে ১০০ কোটি বছর পরে হয়তো পৃথিবী থেকে আর কোনো গ্রহণই দেখা যাবে না। গ্রহণহীন সেই পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা কেমন হবে? সে আরেক মজার বিষয়। এ নিয়ে পরে কখনো বিস্তারিত লিখব।