আবুল খায়ের : করোনার মতো মহাদুর্যোগের মধ্যে উঠে আসছে স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়মের চিত্র। এরই ধারাবাহিকতায় এবার উঠে এসেছে করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত দেশের প্রথম হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সাগর চুরির তথ্য। কেনাকাটায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বাজার দরের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে। ১০ লাখ টাকা মূল্যের একটি যন্ত্রের দাম দেখানো হয়েছে ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা!
অনুসন্ধানে দেখা গেছে—হাসপাতালের ক্রয় কমিটিকে পাশ কাটিয়ে নামসর্বস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে নিজের শ্যালক ও ভাগ্নেকে কাজ দিয়েছেন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন। শুধু কাজ দেওয়াই নয়; স্টোরে মালামাল জমা পড়ার আগেই পরিশোধ করে দিয়েছেন সব বিল। পরে আর তা সরবরাহ করা হয়নি। করোনার সময়ে কেনা এ ধরনের ৯৩টি বিল কারসাজির তথ্য উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। এর মাধ্যমে ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকার কার্যাদেশ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় পুরোটাই। করোনাকালে স্বাস্থ্য সেক্টরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতি হয়েছে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে কেনাকাটায়। সর্বোচ্চ দুর্নীতি হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। জানা গেছে, ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে ডা. সেহাব উদ্দিন নিজেই বিভিন্ন নামে ব্যবসা করছেন। এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন শ্যালক জাকারিয়া ও ভাগ্নে মহিউদ্দিনকে। সে সব জিনিসের দরকার নেই তাও কেনা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ডা. সেহাবের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বিষয়টি দুদক তদন্ত করছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, কুয়েত মৈত্রীর সুপারের পক্ষে একা এত বড় দুর্নীতি করা সম্ভব না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। যেই জড়িত থাকুক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি। অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, উনি একসময় সিলেট মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেহাব ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসানের সহযোগিতায় এত বড় দুর্নীতি হয়েছে। অথচ তাকে ঢাকা বিভাগের (স্বাস্থ্য) মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে দুদক থেকে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। বিএমএ নেতৃবৃন্দ বলেন, ছাত্রদলের নেতাদের ভালো জায়গায় বদলি করলে সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করবে—এটাই স্বাভাবিক। দুর্নীতি করেছে তারা, খেসারত দেবে শেখ হাসিনার সরকার।
গত কয়েক মাসে নিজ ক্ষমতায় ক্রয়ের নামে লুটপাট করা তত্ত্বাবধায়ক সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট ক্রয় কমিটির দুই সদস্যকে জরুরি তলব করে পূর্বের বিভিন্ন তারিখের প্রায় অর্ধ শতাধিক স্বাক্ষর নিয়েছেন। আর স্বাক্ষর দিয়ে বিপাকে ক্রয় কমিটির দুই সদস্য ডা. সোহেলী পারভীন ও ডা. মামুনুর রশীদ। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে ডা. সেহাব উদ্দিন হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া নিয়ে মহাপ্রতারক মো. সাহেদের সঙ্গে কয়েকগুণ বেশি দামে চুক্তি করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, নার্সদের নিম্নমানের খাবার দেওয়ারও। যেখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন ডা. সেহাব। হাসপাতালের চিকিৎসকদের হোটেলে থাকা ও খাবার বিলেও অসংগতি পাওয়া গেছে। আর ডা. সেহাবের এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করায় ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামানকে বদলি করা হয়েছে বাগেরহাট সিভিল সার্জন অফিসে। স্টোরে মাল নেই, বিল দেব কীভাবে?—এই কথা বলার কারণে বদলি হতে হয় ঐ প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে।
অনুসন্ধানে পাওয়া গত ৩০ মার্চের এক কার্যপত্রে দেখা যায়, মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানকে ডিপিএম পদ্ধতিতে ১২ ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৪১ হাজার ৭৫০ টাকার কার্যপত্র দেওয়া হয়েছে। মার্চ মাসেই এভাবে আরো তিনটি কার্যপত্র দেওয়া হয়েছে একই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে। ১২ মার্চের কার্যপত্রের মাধ্যমে সাত ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ১৫ মার্চে ১১ ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২ কোটি ৮৩ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং ২৫ মার্চে পাঁচ ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেন ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন। এসব ভারি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ২৫০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি যন্ত্রপাতিই প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ভুয়া এই প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়ের জন্য দেওয়া হয়। ৩০ মার্চে স্বাক্ষর করা কার্যপত্রের ৬ নম্বর তালিকায় পিসিআর মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ। অথচ এ মানের একটি পিসিআর মেশিনের দাম ২৫ লাখ টাকা। একই কার্যপত্রের ৪ নম্বরে ডেফ্রিব্লেটর নামে একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা। অথচ এটির দাম সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। ৫ নম্বরে সেন্ট্রাল মাল্টিপারপাস প্যাশেন্ট মনিটর নামে যন্ত্রটির দাম ধরা হয়েছে ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই মেশিনটির সর্বোচ্চ দাম ১০ লাখ টাকা। এদিকে কার্যপত্রে যেসব দেশ ও ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ করা হয়নি। চীন থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে আমেরিকা, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন নামি-দামি কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। জিপিও নং-১৯, মহাখালী সি/এ, বনানী ঢাকা নামে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় সরেজমিনে দেখা গেছে, মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব-ই নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেসার্স আলী ট্রেডার্সের প্যাড ব্যবহার করে ডা. সেহাব উদ্দিনের শ্যালক জাকারিয়া এই কার্যাদেশ নিয়েছেন। যে প্যাডে আলী ট্রেডার্সের মালিক আলমগীরের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়নি।
ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন এসব অনিয়ম শুধু হাসপাতালের ভারি যন্ত্রপাতি ক্রয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি। হাসপাতালের এমএসআর/চিকিৎসা ও শৈল্যচিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয়েও একই চিত্র উঠে এসেছে। ফকিরাপুলের ১২০, হাবিবুল্লাহ ম্যানশনের জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেক নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬৫০ টাকার কার্যাদেশ দিয়েছেন। এসব সরঞ্জামাদি সরবরাহ না করেই ডা. সেহাব উদ্দিনের ভাগনে মহিউদ্দিনের প্রতিষ্ঠান জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এই টাকা উঠিয়ে নিয়েছে।
এদিকে হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিনের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে পূর্বের বিভিন্ন তারিখের এবং তারিখ ছাড়া বিভিন্ন কাগজে প্রায় অর্ধশতাধিক স্বাক্ষর করে বিপাকে আছেন ক্রয় কমিটির দুই সদস্য ডা. সোহেলী পারভীন ও ডা. মামুনুর রশীদ। ৪০ থেকে ৫০টি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। মার্চ থেকে এপ্রিল ও মের বিভিন্ন তারিখের ব্যাকডেটে এ স্বাক্ষর নিয়েছে। এমনকি অনেকগুলোতে তারিখ ছাড়াই স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের সাগর চুরির বিষয়টি লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবের কাছে দেওয়া হয়েছে।
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন বলেন, সবকিছু তদন্ত চলছে। দেখেন কি হয়। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম সারওয়ারুল আলম বলেন, ‘কিছু দুর্নীতি আমি আসার আগে হয়েছে। আবার কিছু হয়েছে আমি আসার পর। এটা বড় ব্যাপার-সেপার। এটা নিয়ে আমাকে আর কিছু বলার অনুরোধ করবেন না।’ সূত্র : ইত্তেফাক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।