এ কে এম জামীর উদ্দীন: মোবাইল ফোনভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত কিছু বিনিয়োগকারী ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য বেপরোয়া তদ্বির চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে এমন ধরনের কিছু আর্থিক সেবা চালু করার বিষয়ে তারা উদ্যোগ নিয়েছে, যা আইন অনুযায়ী কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান করতে পারে না।
প্রস্তাবিত এই ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা নন ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (এনবিএফআই) একই সঙ্গে এক লাইসেন্সে মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করতে চায়।
গত তিন মাসে ওই বিনিয়োগকারীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য তিনবার আবেদন করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর মধ্যে দুইবার আবেদন বাতিল করে দিয়েছে। এরপরও তৃতীয়বারের মতো আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন তারা।
কিন্তু, তারা তৃতীয়বারের আবেদনপ্রত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘আমার ফিনটেক লিমিটেড’ থেকে পরিবর্তন করে ‘নগদ ফাইন্যান্স লিমিটেড’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এই বিনিয়োগকারীরা কেন এক লাইসেন্সে ভিন্ন ভিন্ন তিন কাজ করতে চায় সেটি এখন আলোচনার খোরাক হিসেবে উদ্ভুত হয়েছে।
এই ধরনের হাইব্রিড আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বর্তমানে দেশে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এদের অনেকেই দুর্নীতিতে জর্জরিত। ফলে আমানতকারীর টাকাও ফেরত দিতে পারছে না তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে, নতুন কোনো কোম্পানিকে অনুমোদন না দিয়ে বর্তমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নিয়মকানুন আরও শক্ত করা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান সঙ্কটে জর্জরিত। ফলে নতুন কাউকে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক অবস্থান নিতে হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩ অনুযায়ী, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান চলতি আমানত নিতে পারে না। শুধুমাত্র ব্যাংকই এই ধরনের আমানত নিতে পারে। আমানতকারী চাওয়ামাত্র চলতি আমানতের টাকা পরিশোধ করে দিতে হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান শুধু মাত্র স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট নিতে পারে। এই টাকা উত্তোলনের জন্য একজন আমানতকারীকে কমপক্ষে তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়।
কিন্তু, মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা টাকা আমানতকারী যেকোনো সময় উত্তোলন করতে পারে। এখানেই আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর এমএফএস-এর বড় পার্থক্য।
সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, কেউ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে চাইলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওই নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে এমএফএস বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রম সম্পর্কিত নয়।
সালেহউদ্দীন বলেন, ‘একটি কোম্পানির পক্ষে ভিন্ন ভিন্ন একাধিক কাজ করা কীভাবে সম্ভব?’
‘মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে যদি নগদ নামে আরও একটি কোম্পানিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়। কারণ, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ইতোমধ্যে নগদকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রচার করে এর এমএফএস পরিচালনা করছে।’
আর্থিকখাতের আরও একজন বিশেষজ্ঞ নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এই ধরনের সুবিধা একজনকে দিলে পর্যায়ক্রমে সবাইকে দিতে হবে।
গত বছরের নভেম্বরে ওই বিনিয়োগকারীরা আমার ফিনটেক’র লাইসেন্সের জন্য প্রথম আবেদন করেন। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার বৈঠকেও বসেন। কিন্তু, আইনের ব্যত্যয় হবে এই কারণে আবেদন বাতিল করা হয়। এরপরও ওই ব্যবসায়ীরা চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি আবার আবেদন করেন। সেবারও তাদের আবেদন আমলে নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেননা, এমএফএস ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাতে পারে না কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু, কোনো কিছুতেই তাদের তদ্বির থামছে না। তারা গত ২০ জানুয়ারি আমার ফিনটেকের নাম পরিবর্তন করে নগদ ফাইন্যান্সের নামে আবেদন করেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেন, কোম্পানিটি ক্ষুদ্র অঙ্কের ঋণ বিতরণ করতে চায়।
এসব আবেদনপ্রত্রে চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মোহম্মদ ফরিদ খানকে। তিনি সামিট গ্রুপ অব কোম্পানিজের ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
ফরিদ খানের ছেলে ফারহান করিম খান প্রস্তাবিত আমার ফিনটেক ও নগদ ফাইন্যান্সের বোর্ডে পরিচালক হিসেবে আবেদনপত্রগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের পাশাপাশি আরেকজন পরিচালক হচ্ছেন রুবেল আহসান।
তারা তিনজনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আমার ক্যাপিট্যাল এলএলসির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
প্রস্তাবিত দুই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাহেল আহমেদকে। তিনি বর্তমানে নগদ লিমিটেডের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ও বোর্ডের একজন পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথম আবেদনপত্র বাতিল করার পর ৩ জানুয়ারি ফরিদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ৫ জানুয়ারি তিনি বলেন, পুনরায় আবেদন করার বিষয়ে তারা এখনও সিদ্ধান্ত নেননি। তবে প্রস্তাবিত কোম্পানির সঙ্গে সামিট গ্রুপের কোনো সম্পর্ক নেই।
নগদ ফাইন্যান্সের দরখাস্ত দাখিল করার পর ফরিদ খানের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করে। এবার তিনি কোনো জবাব দেননি।
ফরিদ খানের সই করা দরখাস্তে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত কোম্পানির যেকোনো তথ্যের জন্য প্রয়োজনে রাহেল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি মাসের প্রথমদিকে রাহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার কাছে নগদ লিমিটেড ও নগদ ফাইন্যান্সের নামের সাদৃশ্য নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, দুই কোম্পানির আন্তসম্পর্ক নিয়ে তিনি কোনো কিছু জানেন না। তিনি এর আগে প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এসব বিষয় নিয়ে জানার জন্য গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর যোগাযোগ করা হয় নগদ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ফিনটেক নিয়ে আমার পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই।’
কিন্তু, ইমেইলের জবাবে ৮ ফেব্রুয়ারি তানভীর বলেন, ‘নগদ লিমিটেড ও নগদ ফাইন্যান্সের মধ্যে আন্তসম্পর্ক আছে।’
‘কিন্তু, সম্পর্কের ধরনটি এই মুহূর্তে প্রকাশ করা যাবে না। কারণ, কোম্পানিটি এখনও গঠিত হয়নি।’
নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর শিগগির এই বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কেন নগদ লিমিটেড বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে
প্রথমেই জানতে হবে নগদ কী? মূলত, এটি ডাক বিভাগের একটি ব্র্যান্ডের নাম, যেটির মাধ্যমে এমএফএস পরিচালনা করা হয়। এই সার্ভিস পরিচালনা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেডকে। এই কোম্পানিকে নগদের মাস্টার এজেন্ট হিসেবেও সরকারি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডাক বিভাগের নগদ প্লাটফর্ম ব্যবহার করছে এখন পাঁচ কোটির বেশি গ্রাহক। অভিযোগ আছে, ডাকবিভাগকে না জানিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে থার্ড ওয়েভ নিজ নাম পরিবর্তন করে নগড লিমিটেড হিসেবে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধন করে।
২০১৯ থেকে ডাকবিভাগ এমএফএস সার্ভিস পরিচালনা করছে। কিন্তু, এখনও সার্ভিসটি পরিচালনা করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তবর্তীকালীন লাইসেন্স নিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এমএফএস পরিচালনা করতে হলে ডাক বিভাগকে একটি সাবসিডিয়ারি বা সহযোগী কোম্পানি তৈরি করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে চারবার অন্তবর্তী লাইসেন্সের মেয়াদ বাড়িয়েছে। কিন্তু, আইনগত জটিলতার কারণে সরকারি সংস্থাটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি তৈরি করতে পারেনি। নতুন সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে নগদ লিমিটেড ৪৯ শতাংশ শেয়ার ধারণ করার কথা রয়েছে। বাকি ৫১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করবে ডাক বিভাগ।
নগদ ফাইন্যান্স কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে
আবেদনপত্রে নগদ ফাইন্যান্স লিমিটেড বলেছে, প্রস্তাবিত কোম্পানিটি ‘১০০ শতাংশ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন’ হিসেবে কাজ করবে।
কোম্পানিটি এমএফএস পরিচালনা করার জন্য নিজেই একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করবে। এর ৫১ শতাংশ মালিকানায় থাকবে নগদ ফাইন্যান্স। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণ বা ছোটো অংকের ঋণ বিতরণ করবে কোম্পানিটি। আমানতকারীদের দেওয়ার হবে ডেবিট ও প্রিপেইড কার্ড। কোনো শাখা খুলবে না কোম্পানিটি। পুরো কার্যক্রম চলবে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থান
যোগাযোগ করা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, নগদ ফাইন্যান্সের আবেদনটি পর্যালোচনাধীন রয়েছে।
এর আগে বাতিল হওয়া দুইটি আবেদনপত্র নিয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, একমাত্র ব্যাংক বা এর সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এমএফএস পরিচালনা করতে পারবে।
কোনো এমএফএস ঋণ দিতে পারবে না। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ব্যাংকের হয়ে ঋণ দিতে পারবে ঋণগ্রহীতাদের।
একটি এমএফএস পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র গ্রাহকের টাকা এক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেক স্থানান্তর করতে পারবে। পাশাপাশি, ইউটিলিটি বিল, মোবাইল ফোনে ব্যালেন্স যোগ করা, সরকারের ভর্তুকীর টাকা সরবরাহ করার মতো কাজগুলো করতে পারবে।
অধিকন্তু, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি ক্ষুদ্রঋণ দিতে চায়, তাহলে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
কিন্তু, এসবের মধ্যেই ১৫ ফেব্রুয়ারি এমএফএস’র বিধিমালা পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এখন থেকে ব্যাংকের পাশাপাশি মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা দিতে পারবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর জন্য গঠন করতে হবে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি।
কিন্তু, ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিশন অ্যাক্ট ১৯৯৩ অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র কয়েকটি সেক্টরে কাজ করতে পারবে। এর মধ্যে কিছু খাতে ঋণ দিতে পারবে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিল্প, গৃহায়ণ, কৃষি ও স্টক মার্কেট।
এ বিষয়ে সিরাজুলের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবসিডিয়ারি গঠন করেও এমএফএস চালু করতে পারবে না।
তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমএফএস চালু করতে চাইলে আইন সংশোধন করতে হবে।
সিরাজুলের কাছে জানতে চাওয়া হয় এরপরও কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমএফএস-এর বিধিমালা সংশোধন করল। তিনি বলেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে এমএফএস-এর আওতা বাড়ানো হয়েছে।
এই উদ্যোগ নগদ ফাইন্যান্সের আবেদনকে যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, নতুন বিধিমালা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে।
সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।