জুমবাংলা ডেস্ক : হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পাম্প বন্ধ রেখে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ষোল জেলা থেকে মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে হাতিয়ে নিয়েছে ২০০ কোটি টাকারও বেশি। পূর্বের দামে ক্রয় করা মজুদ জ্বালানি বর্ধিত দরে বিক্রি করায় তারা এই বাড়তি মুনাফা করতে পেরেছে বলে জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজন। সরকারের পরিকল্পনার অভাবে পাম্প মালিকরা এ সুযোগ নিয়েছে বলে মনে করছে তারা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে প্রাত্যহিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই। এতে ক্ষুব্ধ উত্তরাঞ্চলের মানুষ। তারা পুনরায় দাম সমন্বয় করে সহনীয় মাত্রায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ভোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলে মূল্য এর আগেও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এবার বৃদ্ধির হার এই প্রথম এতো বেশি এবং অস্বাভাবিক। শুক্রবার (৫ আগস্ট) রাত ১০ টায় ডিজেল ও কেরোসিন ৪২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোল ৫১.১৬ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৫১.৬৮% শতাংশ বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। রাত ১২ টার পর থেকেই তা কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু রাত ১০ টায় এই ঘোষণার সাথে সাথে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ২টি সিটি করপোরেশনসহ ১৩২ উপজেলার ৯৫ ভাগেরও বেশি পাম্প বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দেন সংশ্লিষ্টরা। শেষবারের মতো আগের দামে জ্বালানি কিনতে পাম্পগুলোতে ভিড় করেও কোনো কাজ হয়নি গ্রাহকদের। রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্বরের ইউনিক পাম্পের সামনের রাস্তা অবরোধ করে দেয় মোটরসাইকেল চালকরা। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে সেখানে রাস্তা বন্ধ থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ এসে বাইকারদের সড়কের একপাশে সরিয়ে দেয়।
সেখানে উপস্থিত মাহবুব নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, টেলিভিশনে খবর দেখে শাপলায় তেল নিতে আসলাম। এসে দেখি আমার মতো অনেকেই অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তেল না দিয়ে মালিক বন্ধ করে চলে গেছে। এর পাশে একটা আছে সেটাও বন্ধ।
সেখানে তেল নিতে আসা কলেজ শিক্ষক নুরুল ইসলাম নুরু জানান, দাম যেহেতু বেড়ে গেলো সেহেতু ভাবলাম যদি আগের দামে পেট্রোল নিতে পারি, সেজন্যই শাপলায় আসা। আমি কিছু বোতল নিয়েও এসেছিলাম। অতিরিক্ত তেল নেয়ার জন্য। কিন্তু প্রয়োজনীয়টাই পেলাম না। পাম্পই বন্ধ। এটা ঠিক নয়। তারা আগের মজুদ করা তেল বেশি দামে বিক্রি করার জন্যই পাম্প বন্ধ রেখেছে।
আরেক ক্রেতা ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম মুন জানালেন, দাম বৃদ্ধি হোক, কিন্তু আমাকে তো তেল নিতে হবে। মানুষের এটা প্রয়োজন। কিন্তু পাম্প মালিকরা পাম্পগুলো রাত ১০টার আগেই বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছে। এটা হতে পারে না। তারা জনগণকে কোনো নোটিশ দেয় নাই। গণ অধিকার হরণ হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নষ্ট হচ্ছে। এখানে পুলিশ এসে পাম্প পাহারা দিতেছে। কিন্তু পাম্প মালিকদের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা তেল দেয়ার ব্যবস্থা করছে না।
আবুল কালাম আজাদ নামের গ্রাহক জানালেন, মডার্নে গেছিলাম, তেল নাই। টার্মিনাল, সিও বাজার, ব্যাংক মোড়, সালেক পাম্প কোথাও পাম্প খোলা নাই। শাপলা এসেও দেখি খোলা নাই। তারা তেল মজুদ করে রাখছে। পাম্পগুলোতে প্রশাসন দাড়িয়ে আছে। আসলে আমরা কোথায় যাবো?
পাম্প বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ইউনিক পেট্রোল পাম্পের ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম জানালেন, গতকাল (শুক্রবার রাতে) পাম্প বন্ধ করতে না পারলে আজ (শনিবার) ও কাল (রোববার) তেল দিতে পারতাম না। রেট বেশি হওয়া ঘোষণার সাথে সাথেই বিপুল পরিমাণ মোটরসাইকেল ও গাড়ির চাপ তৈরি হয়, সে কারণে পাম্পবন্ধ করে দিয়ে পালাইছি। তিনি বলেন, তার পাম্পে প্রতিদিন ৯ হাজার লিটার জ্বালানির প্রয়োজন হয়। মজুদ আছে ৩/৪ দিনের। দাম বৃদ্ধি হওয়ায় আমাদেরও হয়রানি, গ্রাহকদেরও দুর্ভোগ। তিনি বলেন, গদ দুই তিন সপ্তাহ ধরে জ্বালানি তেলের সংকট ছিল। এখন স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এখানেও যুক্তি দিয়ে তিনি জানান, সরকারও তেল আটকে রেখেছিল, যাতে মালিকরা স্টক করতে না পারে। এখন যেহেতু দাম বাড়িয়েছে এখন সরবরাহও স্বাভাবিক হবে।
ইউনিক পেট্রোল পাম্পের মালিক তাজুল ইসলাম রন্টু জানান, তেলের সংকট। যেখানে ১০ গাড়ির দরকার, সেখানে আমরা পাইছি ১ গাড়ি। লোকজনকে ১০ লিটারের পরিবর্তে ৫ লিটার, ৩ লিটারের পরিবর্তে ১ লিটার করে দিয়ে পার করেছি। তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি রাষ্ট্রের ব্যাপার। দাম কম অথবা বেশি হলে সেটা সাথে সাথে প্রশাসন দায়িত্বে নিয়ে নেয়। আমাদের করার কিছু নেই।
পেট্রোল পাম্পগুলো বন্ধের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজন। সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু জানান, হঠাৎ করে যে তেলের দাম বাড়ানো হলো, এতে করে মধ্যস্বত্বভোগীরা একটা বড় মুনাফা করে ফেলেছে। যেটা দুঃখজনক হলেও সত্য,বাংলাদশে যখন কোনো কিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়, তখন যারা এটার ভোক্তা, জনগণ, তাদের কাছে এটা যায় না। সেই তথ্য আগাম চলে যায় মুনাফাখোর ও ব্যবসায়ীদের কাছে। পেট্রোল ডিজেল এবং অকটেনের ব্যাপারে যেটা হলো, শুক্রবার রাত ১০টায় যখন দাম বাড়িয়ে দেয়া হলো, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৮০০ পেট্রোল পাম্প ছিল। তারা তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলো বন্ধ করে দিলো। কিন্তু তারা রাত ১২ টার পর তেলটা বিক্রি করলেন। কিন্তু আগের কেনা তেল তারা বিক্রি করলেন বর্ধিত দরে। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে তারা এর মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত টাকা তারা জনগণের কাছ থেকে তুলে নিলেন। এই যে জনগনের টাকা, এটা যে কত মূল্যহীন সেটা বোঝা যায়।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সপ্তা খানেক আগেও বললেন দেশের পেট্রোল-অকটেন পর্যাপ্ত আছে। আমরাই রিফাইনিং করি। শুধু ডিজেল আমদানি করা হয়। তাহলে কী এমন হলো এতো অস্বাভাবিকভাবে জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হলো। এখন এর পুরো প্রভাব পড়েছে পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, পোশাক শিল্প, কৃষিসহ সবখানে। এই দায় সরকারকে নিতে হবে।
একটি পরিকল্পনা করে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ আলোচনা করে জনগণকে জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে সেটা রাষ্ট্রের জন্য খারাপ হয়। এটা নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে। অবিলম্বে দাম সমন্বয় করে জ্বালানির মূল্য সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার দাবি জানান তিনি।
সুজনের এই নীতিনির্ধারক আরও জানান, সরকারের উচিত ছিল দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়ার আগেই প্রত্যেক পেট্রোল পাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পাম্পগুলো খুলে রেখে আগের দরেই জ্বালানি তেল বিক্রি করতে মালিকদের বাধ্য করা। কিন্তু প্রশাসন পাম্পগুলোতে অবস্থান নিলেও সেটি তারা করেনি। এটি করা হলেও মানুষের ক্ষোভ কিছুটা হলেও কমতো। পাম্প মালিকরা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতে পারতো না।
একাধিক গোয়েন্দা তথ্য এবং পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতি ও মালিকদের সূত্র জানিয়েছে, উত্তরের ষোল জেলায় ৮ শতাধিক পেট্রোল পাম্প আছে। এসব পাম্প থেকে কমবেশি প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার লিটার জ্বালানি তেল বেচাবিক্রি হয়। যখন দাম বৃদ্ধি করা হয় সেই মুহূর্তে পাম্পগুলোতে মজুদের পরিমাণ ছিল ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত। এসব জ্বালানি ছিল আগের দামে কেনা। দামবৃদ্ধি কার্যকর হওয়ার পর থেকে আগের দামে কেনা বিপুল পরিমাণ জ্বালানি বিক্রি করা হচ্ছে বর্ধিত দরে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।