জুমবাংলা ডেস্ক : বিশ্ব বাজারের সংকটময় সময়ে তেল-গ্যাসের বিকল্প বাজার খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সরকার। অবশেষে এর ফল পাওয়া যাচ্ছে। ২১ লাখ টন তেল পাওয়া যাবে ব্রæনাই থেকে। শুধু তেলই নয় দেশটি থেকে আসবে দেড় মিলিয়ন টন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও (এলএনজি)।
এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে সফলভাবে। নতুন বছরের শুরুতেই এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এটি স্বাক্ষরিত হলে সাম্প্রতিক সংকট কিছুটা হলেও কাটবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির বাজার যখন টালমাটাল তখন চাহিদা থাকলেও চুক্তির বাইরে এলএনজি দিতে অস্বীকৃতি জানায় কাতার। স্পট মার্কেটে চড়ামূল্যে ভর্তুকি দিয়ে গ্যাসে কেনাও ছিল বন্ধ। বিদ্যুৎ সংকট কাটাতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোও চলে পুরোদমে। ফলে শিল্প, আবাসিক এমনকি বাণিজ্যিক খাতের গ্রাহকদের গ্যাস সংকটে পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। সরকার বিকল্প উপায়ের সন্ধান করলেও এখনো তারা সুফল মেলেনি। তবে আশার আলো দেখা যায় সম্প্রতি ব্রুনাইয়ের সুলতানের সফরকালে। দেশটি থেকে তেল-গ্যাস পাওয়ার আশ্বাস মেলে। ওই সময় গ্যাস আমদানির লক্ষ্যে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ভিত্তিতে দেশটি থেকে গ্যাস দীর্ঘমেয়াদে গ্যাস আনার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য একটি প্রতিনিধি চলতি মাসে সফর করে ব্রুনাই। একই সঙ্গে সৌদি আরব থেকেও দীর্ঘমেয়াদে স্বল্পমূল্যে গ্যাস আনার প্রক্রিয়া চালায় সরকার। এরই সুফল পাওয়ার আভাস মিলেছে বৃহস্পতিবার।
এদিন সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে একটি সফল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে ব্রুনাইয়ের জ্বালানি উপমন্ত্রী ইয়ং মুলিয়াদাতো সেরি পাদুকাওয়াং হজ মাতসাতেজো বিন সোকিয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে। এসময় এলএনজিসহ অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়।
এ বৈঠকের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, তেল-গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ব্রæনাই থেকে বছরে ১ থেকে দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি ২০২৩ সালের শুরুতেই পেতে চাচ্ছি। ১০-১৫ বছর মেয়াদী চুক্তি হতে পারে তাদের সঙ্গে। শুধু তাই নয় বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্রæনাই থেকে গড়ে ২ লাখ ১০ হাজার টন ডিজেল আনা হবে। পরে মূল্য পরিশোধের ভিত্তিতে এই ডিজেল আসবে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এসব বিষয় নিয়ে নতুন করে চুক্তি করতে হবে। যা খুব শীঘ্রই হবে বলে আমরা আশা করছি।
তবে এবারই প্রথম নয়। এর আগেও ব্রুনাই থেকে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মোট ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৭৫ মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করা হয়েছে। তবে শতভাগ নিজস্ব রিফাইনারি থাকার শর্তের জন্য ব্রæনাইয়ের কোম্পানি পিবি ট্রেডিং সেন্ডিরিয়ানবারহাড থেকে ২০১৬ সালের পর আর আমদানি করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে এই শর্ত শিথিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি ব্রুনাইয়ের সুলতান বাংলাদেশে সফরকালে বাংলাদেশ ও ব্রুনাই জ্বালানি খাতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার কৌশল খুঁজে বের করতে সম্মত হয়েছিল। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ব্রæনাইয়ের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহর উপস্থিতেতে বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ে মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং অন্যান্য পেট্রোলিয়াম সরবরাহে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল দুই বছর মেয়াদে বাংলাদেশ এবং ব্রæনাইয়ের মধ্যে সরকার-টু-সরকার (জিটুজি) ব্যবস্থার মাধ্যমে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। শুধু তাই নয় সৌদি আরব থেকেও গ্যাস আনার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, সম্প্রতি সৌদি অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তাদের মন্ত্রী আসছেন। ২০২৮-২৯ সালের দিকে সৌদি আরব থেকে গ্যাস নিতে পারবো। আমাদের এখানে সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারেও কথা হয়েছে। তারা সৌর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ১০০০ মেগাওয়াট এমওইউ করার কথা জানিয়েছে। আমরা আশা করছি আগামী বছর ১০০-১১০ এমএমসি গ্যাস পাব। পাওয়ারের রিকয়্যারমেন্ট ১০ শতাংশ বাড়বে। এদিকে সমুদ্র থেকে গ্যাস পাওয়ার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সাগর থেকে গ্যাস তোলার জন্য দুইবার টেন্ডার দেয়া হয়েছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আবারো এখানে টেন্ডার দেয়া হবে। সাগর থেকে গ্যাস তোলা কষ্টসাধ্য। বিনিয়োগ করেও সফলতা পাওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা থাকে না। বাপেক্সকে দিয়ে এটা করা যাবে না। তবে বাপেক্স বিদেশীূ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে কাজ করতে পারে।
এদিকে বাপেক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২২-২০২৫ সালের মধ্যে বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা মোট ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্ক ওভার কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে বাপেক্সের তত্ত্বাবধানে গ্যাজপ্রমের মাধ্যমে গত ১৯ আগস্ট ভোলা জেলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্রের টবগী-১ অনুসন্ধান কূপে প্রায় ৩৫০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত খনন কাজ শুরু করে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ৩৫২৪ মিটার গভীরতায় খনন কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
গত ৩ নভেম্বর এখানে ২৩৯ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে বলে জানান বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এই খনন কাজের বিষয়ে তিনি বলেন, এই কূপে ৩০ থেকে ৩১ বছর পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হবে। তিনি জানান, এই গ্যাসের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৮০৫৯.০৮ কোটি টাকা। শুধু তাই নয় আগামী জুনের মধ্যে এ প্রকল্পে আরও ২টি কূপ (ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২) খনন করা হবে। এই ৩টি কূপ থেকে দৈনিক সর্বমোট ৪৬ থেকে ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হবে।
এর ঠিক ৭ দিন পর সিলেটের বিয়ানীবাজারে পরিত্যক্ত কূপে নতুন গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় বাপেক্স। এখান থেকেও দিনে অন্তত ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে জানিয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জনকণ্ঠকে বলেন, প্রায় ৪০ বছর আগের এই কূপটিতে আমরা ওয়ার্কওভারের কাজ করছিলাম। সেইখানেই এই গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। এখনও কূপটিতে কাজ চলছে। এসব কাজ শেষ হতে আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে। এরপর আমরা এসব বিষয় নিশ্চিত করতে পারবো।
তিনি জানান, কূপের তিন হাজার ৪৫৪ মিটার গভীর থেকে পরীক্ষা করে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে এখন গ্যাসের চাপ রয়েছে তিন হাজার ১০০ পিএসআই। তিনি বলেন, এই কূপের কাজ শেষ করার পরপরই আমরা সিলেটে আরও ৪টি কূপে অনুসন্ধান কাজ শুরু করবো। এই কূপগুলো হলো কৈলাশটিলা-২, কৈলাশটিলা-৫, সিলেট-৭, রশিদপুর-৫। আশা করছি এসব কূপেও গ্যাস পাওয়া যাবে।
বাপেক্স বলছে, বর্তমানে বর্তমানে দৈনিক ১৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) উৎপাদন করছে ৬১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড উৎপাদন করছে ১০৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সব মিলিয়ে এই তিন কোম্পানি দৈনিক মোট ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। আর বাকিটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শেভরন আর আমদানি করা এলএনজি। কিন্তু এই উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে আগামী তিন বছর নতুন করে কূপ খনন করার পাশাপাশি বিকল্প বাজারের সন্ধানে ছিল সরকার।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। কাতারের রাশ লাফান লিক্যুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। সাইড লেটার চুক্তির মাধ্যমে এর অতিরিক্ত হিসেবে বছরে আরও ১ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু কাতার তাতে সাড়া দেয়নি।
তা সত্তে্বও সম্প্রতি কাতারের দোহায় দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠকে (এফওসি) বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কাতারকে আরও বেশি পরিমাণে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কাতার জানিয়েছে, ২০২৫ সালের আগে বিদ্যমান চুক্তির আওতায় অতিরিক্ত এলএনজি সরবরাহ করতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে দেশীয় কূপ খননের উদ্যোগের প্রেক্ষিতে স¤প্রতি ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের টবগী-১ কূপের খননকাজ শুরু করে বাপেক্স।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।