সাধারণ কাগজের সাহায্যে গণিতের মজার একটা খেলা দেখানো যায়। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগবে। তাই গণিতের সাহায্যে আমরা প্রমাণ করেও দেখব। কাজটাও খুব সহজ। একটা কাগজ নেবেন। চারবার ভাঁজ করবেন সেটা। তারপর আরও চারবার। মোট আটবার। এরপর যদি আরও আটবার কাগজটা ভাঁজ করতে বলি? ভাবছেন, এ আর এমন কঠিন কী কাজ? ২ মিনিটে করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু আসলেই যদি আপনি উদ্যোগ নিয়ে এ কাজ করতে পারেন, তাহলে একটা বিশ্ব রেকর্ড তৈরি হবে। আপনি হবেন সেই রেকর্ডের মালিক। চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে চেষ্টা করার আগে লেখাটা সম্পূর্ণ পড়ে নেওয়াই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
একটা A4 সাইজের কাগজ নিন। ওটা মাঝামাঝি ভাঁজ করুন। তাহলে আগের তুলনায় কাগজটা দ্বিগুণ মোটা হলো। এবার আরও একবার ভাঁজ করুন কাগজটা। তাহলে A4 কাগজটার তুলনায় এখন চারগুণ মোটা হয়েছে। এর মধ্যে আপনি ভাঁজ করেছেন সবে ২ বার। যদি আরও একবার ভাঁজ করেন, তাহলে ৮ গুণ মোটা হবে। এভাবে যতবার সম্ভব ভাঁজ করুন। সম্ভবত ৮ বারের বেশি আপনি ভাঁজ করতে পারবেন না।
প্রথমবার ভাঁজে শুরুর চেয়ে ২ গুণ মোটা হবে, তারপর ৪ গুণ, ৮ গুণ, ১৬ গুণ, ৩২, গুণ, ৬৪ গুণ। অর্থাৎ ৬ বার ভাঁজ করলেই আগের তুলনায় ৬৪ গুণ মোটা হবে। ৭ বার ভাঁজ করলে মোটা হবে ১২৮ গুণ। অনেকটা নোটবুক আকারের। এবার ভাবুন, ১৬ বার ভাঁজ করতে পারবেন? যদি এখনো আপনার মনোবল বেঁচে থাকে, তাহলে একটা ছোট্ট তথ্য দিই। এখন পর্যন্ত একটা কাগজ সর্বোচ্চ ১২ বার ভাঁজ করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন ব্রিটনি গ্যালিভান।
তবে এখনই হতাশ হবেন না। একজন ১২ বার ভাঁজ করেছেন, আপনি চেষ্টা করলে তো ১৩ বার ভাঁজ করতেই পারেন। তাই মনোবল ধরে রাখুন। আপনি যদি চেষ্টা করে কাগজটা ২৩ বার ভাঁজ করতে পারেন, তাহলে কাগজটা এত মোটা হবে যে এর উচ্চতা হবে প্রায় ১ কিলোমিটার। এবার ভাবতে নিশ্চয়ই অবাক লাগছে। তবে এখনই সব আশা শেষ করবেন না। কারণ, আপনাকে আরও অবাক করে দিতে এখন একটু গণিতের সাহায্য নেব।
সাধারণত, ৫০০ পৃষ্ঠার এক বান্ডিল A4 সাইজের কাগজের উচ্চতা হয় ৫ সেন্টিমিটার। সে ক্ষেত্রে একটা কাগজের উচ্চতা হবে ০.০১ সেন্টিমিটার বা ০.১ মিলিমিটার। এবার বের করার চেষ্টা করব, ২৭ বার ভাঁজ করলে কাগজ কতটা মোটা হবে।
০.১ মিমি × ২ × ২ × ২ × …(২৭ বার, মানে ২৭টা ২),
অর্থাৎ, ০.১ মিলিমিটারের সঙ্গে ২৭টা ২ গুণ করতে হবে। তাহলে গুণফল পাবেন ১৩৪২১৭৭২.৮ মিলিমিটার। কিলোমিটারে প্রকাশ করলে হবে ১৩.৪২১৭৭ কিলোমিটার। এই উচ্চতা মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও বেশি। মানে, আপনি যদি একটা কাগজ ২৭ বার ভাঁজ করতে পারেন, তাহলে তার উচ্চতা মাউন্ট এভারেস্টকেও ছাড়িয়ে যাবে।
যদি ৩০ বার ভাঁজ করতে পারেন? অঙ্ক কষে দেখা যাক। ০.১ মিমি × ২৩০ = ১০৭৩৭৪১৮২.৪ মিলিমিটার বা ১০৭.৪ কিলোমিটার। যদি ৩০ বারের পরিবর্তে ৪২ বার ভাঁজ করতে পারেন, তাহলে কাগজের উচ্চতা এত বেশি হবে যে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের সমান হবে। অর্থাৎ একটা কাগজ ৪২ বার ভাঁজ করতে পারলে ওই কাগজ বেয়ে সরাসরি চলে যাওয়া যাবে পৃথিবী থেকে চাঁদে। আর ৫০ বার ভাঁজ করলে পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্বের ৪/৩ ভাগ দূরত্বের সমান হবে। যদিও এটা বিশ্বাস করা কঠিন বটে। তবে বিশ্বাস করানোর জন্য গণিত আছে। আপাতত গণিতের সাহায্যই নেওয়া যাক।
০.১ মিমি × ২ × ২ × ২ × …(৫০ বার মানে ৫০টা ২),
গুণফল হবে ১১২.৫৮৯৯৯০ × ১০৬ কিলোমিটার। সহজ করে বললে, ১১২.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার বা ১১.২৫ কোটি কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হলো ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার। যদি আর একবার, মানে ৫১ বার ভাঁজ করতে পারেন, তাহলে পৌঁছে যাবেন সূর্যে। পুড়ে যাবেন!
এবার চলুন একনজরে দেখে নিই, কতবার ভাঁজ করলে কাগজ কত মোটা হবে।
ভাঁজ সংখ্যা | যত গুণ হবে | পুরুত্ব (কিলোমিটার) |
---|---|---|
১ | ২ | ০ |
২ | ৪ | ০ |
৩ | ৮ | ০.০০০০০১ |
৪ | ১৬ | ০.০০০০০২ |
৫ | ৩২ | ০.০০০০০৩ |
৬ | ৬৪ | ০.০০০০০৬ |
৭ | ১২৮ | ০.০০০০১৩ |
৮ | ২৫৬ | ০.০০০০২৬ |
৯ | ৫১২ | ০.০০০০৫১ |
১০ | ১,০২৪ | ০.০০০১ |
১১ | ২,০৪৮ | ০.০০০২ |
১২ | ৪,০৯৬ | ০.০০০৪ |
১৩ | ৮,১৯২ | ০.০০০৮ |
১৪ | ১৬,৩৮৪ | ০.০০১৬ |
১৫ | ৩২,৭৬৮ | ০.০০৩৩ |
১৬ | ৬৫,৫৩৬ | ০.০০৬৬ |
১৭ | ১৩১,০৭২ | ০.০১৩১ |
১৮ | ২৬২,১৪৪ | ০.০২৬২ |
১৯ | ৫২৪,২৮৮ | ০.০৫২৪ |
২০ | ১,০৪৮,৫৭৬ | ০.১০৪৯ |
… | ….. | …… |
৩০ | ১,০৭৩,৭৪১,৮২৪ | ১০৭.৪ |
৩৫ | ৩৪,৩৫৯,৭৩৮,৩৬৮ | ৩,৪০০ |
৪০ | ১,০৯৯,৫১১,৬২৭,৭৭৬ | ১০৯,৯০০ |
৪৫ | ৩৫,১৮৪,৩৭২,০৮৮,৮৩২ | ৩,৫০০,০০০ |
৫০ | ১,১২৫,৮৯৯,৯০৬,৮৪২,৬২৪ | ১১২,৫০০,০০০ |
এবার একটু ব্রিটনি গ্যালিভানের কথায় আসি। কাগজ ভাঁজের রেকর্ডটা যেহেতু এখনো তাঁর দখলেই। তিনি প্রায় ৪ হাজার ফুটের সমান (প্রায় ১.২ কিলোমিটার) একটা কাগজ নিয়েছিলেন। আসলে ওটা ছিল টয়লেট পেপার। সর্বোচ্চ ১২ বার কাগজটা ভাঁজ করতে পেরেছিলেন তিনি। এ সংক্রান্ত হিসাব করতে ব্রিটনি একটা সূত্র বানিয়েছেন। সূত্রটা একটু জটিল।
L = π.t/6 (2n + 4) (2n – 1)
এখানে t হলো আপনি যে জিনিস ভাঁজ করবেন, তাঁর পুরত্ব। L মানে যে জিনিসটা ভাঁজ করবেন, তার দৈর্ঘ্য এবং n মানে কতবার ভাঁজ করবেন, তা। এই সূত্রকে বলে পেপার ফোল্ডিং থিওরি।
শেষ করার আগে একটা বাস্তব উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছেন। টিকে গেলেন চাকরিতে। তবে চাকরিটা মাত্র ৭ সপ্তাহের। আপনাকে কোম্পানি থেকে দুটি শর্ত দেওয়া হলো। এই দুটির মধ্যে যেকোনো একটা শর্ত মেনে আপনাকে বেতন নিতে হবে।
শর্ত ১: চাকরির প্রথম দিন আপনি ১০০ টাকা বেতন পাবেন। দ্বিতীয় দিন পাবেন ২০০ টাকা, তৃতীয় দিন ৩০০ টাকা… এবং এভাবে শেষ দিন পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে ১০০ টাকা বাড়বে।
শর্ত ২: চাকরির প্রথম দিন পাবেন ১ পয়সা, দ্বিতীয় দিন তার দ্বিগুণ—২ পয়সা, তৃতীয় দিন ৪ পয়সা, এরপর ৮ পয়সা…এভাবে চলতে থাকবে। প্রতিদিন আগের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা পাবেন।
এখন আপনি কোন শর্ত মেনে টাকা নেবেন? প্রথম শর্ত, নাকি দ্বিতীয়টা? গণিত সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকলে আপনার দ্বিতীয় শর্তটাই মেনে নেওয়া উচিত। কারণ, এতে লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রথম দিনে টাকার পার্থক্য অনেক থাকলেও শেষ দিন গিয়ে সব হিসেব বদলে যাবে। অন্তত ৭ দিন পরে আপনি বুঝতে শুরু করবেন, প্রথম শর্তের চেয়ে দ্বিতীয় শর্তে লাভ বেশি। চলুন, এটাও একটা ছকের সাহায্যে দেখি।
সপ্তাহ | শর্ত ১ | শর্ত ২ |
---|---|---|
১ম সপ্তাহ | ২,৮০০ টাকা | ১.২৭ টাকা |
২য় সপ্তাহ | ৭,৭০০ টাকা | ১৬৩.৮৩ টাকা |
৩য় সপ্তাহ | ১২,৬০০ টাকা | ২০,৯৭১.৫১ টাকা |
৪র্থ সপ্তাহ | ১৭,৫০০ টাকা | ২,৬৮৪,৩৫৪.৫৫ টাকা |
৫ম সপ্তাহ | ২২,৪০০ টাকা | ৩৪৩,৫৯৭,৩৮৩.৬৭ টাকা |
৬ষ্ঠ সপ্তাহ | ২৭,৩০০ টাকা | ৪৩,৯৮০,৪৬৫,১১১.০৩ টাকা |
৭ম সপ্তাহ | ৩২,২০০ টাকা | ৫,৬২৯,৪৯৯,৫৩৪,২১৩.১১ টাকা |
মোট টাকা | ১২২,৫০০ টাকা | ৫,৬৭৩,৮২৬,৩০২,১৯৮.৯৭ টাকা |
হিসেবটা খুব সহজ। প্রথম দিন ১০০ টাকা দিয়ে শুরু করলে ৭ দিনে পাবেন ২ হাজার ৮০০ টাকা। অন্যদিকে দ্বিতীয় শর্ত মানলে পাবেন মাত্র ১ টাকা ২৭ পয়সা। কিন্তু ৭ সপ্তাহ পরে প্রথম শর্ত মেনে নিলে পাবেন ১ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা। দ্বিতীয় শর্ত মেনে টাকা নিলে আপনি বিলিওনিয়ার হয়ে যাবেন। টাকার পরিমাণ এত বেশি হবে যে কোটিতে প্রকাশ করাই কঠিন হয়ে যাবে। বুঝলেন গণিতের কেরামতি!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।