বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: মানুষ প্রথম চাঁদে যায় ১৯৬৯ সালে যা সারা পৃথিবীকে শিহরিত করেছিল। অ্যাপোলো-১১ মিশন থেকে চাঁদের পৃষ্ঠে পা ফেলে নিল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, “মানুষের জন্য এটি ছোট একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিরাট ঘটনা।”
এর পর প্রায় পাঁচ বছর ধরে পৃথিবীর এই উপগ্রহটিতে অবতরণ করেছে মনুষ্যবাহী ছ’টি মিশন, চাঁদের পিঠে হেঁটেছেন মোট ১২ জন নভোচারী।
এসময় তারা ছবি তুলেছেন, পতাকা গেড়েছেন, পরীক্ষা চালিয়েছেন এবং চাঁদের বিভিন্ন স্থান থেকে তারা ৩৮০ কেজির মতো নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন।
সবশেষ মিশনটি পাঠানো হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন ভাবা হয়েছিল ভবিষ্যতে মানুষ ঘন ঘন চাঁদে যাবে এবং উপগ্রহটি মহাকাশ গবেষণায় নিয়মিত এক গন্তব্যে পরিণত হবে।
কিন্তু সেরকম হয়নি। ১৯৭২ সালের ওই মনুষ্য-মিশনই ছিল শেষ অভিযান এবং চাঁদে পৃথিবীর শেষ অতিথি ছিলেন নভোচারী ইউজিন সারনান। তার পরে গত অর্ধ-শতাব্দী কাল ধরে আর কেউ চাঁদে অবতরণ করেন নি।
এক হিসেবে বলা হয়, পৃথিবীতে বর্তমানে যতো মানুষ আছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি চাঁদের পিঠে কাউকে হাঁটতে দেখেনি।
নাসার আর্টেমিস মিশন
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চাঁদে আবার মানুষ পাঠাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেছে। এজন্য তাদের প্রস্তুতি চলছে প্রায় এক দশক ধরে। তাদের আর্টেমিস মিশনে এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৪,০০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ।
তৈরি করেছে এযাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট এসএলএক্স। নাসার লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে এই রকেটে করে চাঁদে আবার মানুষ পাঠানো।
এই দৌড়ে নাসা এখন আর একা নয়। এই প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে আরো কয়েকটি দেশ।
চাঁদকে ঘিরে প্রতিযোগিতা?
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ৫০ বছর পর নাসা কেন চাঁদে মানুষ পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠল? পৃথিবীর এই উপগ্রহটিকে কেন্দ্র করে কি নতুন করে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে?
বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলছেন চাঁদকে ঘিরে চীনের স্বপ্নও আর্টেমিস মিশনের পেছনে একটা কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ চীনও চায় ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে একটা ঘাঁটি গড়ে তুলতে।
নাসার মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলছেন, গত ৫০ বছর ধরে চাঁদে নাসার মানুষ না পাঠানোর পেছনে বৈজ্ঞানিক কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনাতেই তা করা হয়নি।
“গত ২০ বছর ধরে আমেরিকাতে একটা বিতর্ক হয়েছে – ‘আমরা আবার চাঁদে যাবো নাকি চাঁদে তো আমরা গিয়েছি, এবার মঙ্গলে যাবো?’ কিন্তু দেখা গেল মঙ্গলে যাওয়ার এই পরিকল্পনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। নাসার যে বাজেট তার চেয়েও ২০ গুণ বেশি অর্থের প্রয়োজন মঙ্গলে যেতে, যা বাস্তবসম্মত নয়,” বলেন তিনি।
চীনা কিম্বা ভারতীয় মিশনের কারণে নাসা চাঁদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেছে – একথা মানতে রাজি নন মি. ঘোষ।
তিনি বলেন, “দেখুন চাঁদে রোভার আর মানুষ পাঠানো এক জিনিস নয়। রোবট পাঠানো সহজ। কিন্তু মানুষ পাঠানো অনেক কঠিন। এজন্য অনেক শক্তিশালী রকেটের প্রয়োজন। অনেক অর্থের দরকার। চীনের এরকম কোনো রকেট নেই এবং চাঁদে মানুষ পাঠানোর কথা তারা এখনও বলেনি।”
চাঁদে যাওয়া শুরু যেভাবে
আসলে চাঁদে মানুষ অবতরণের এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তার এক ভাষণে এরকম এক স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “আমরা চাঁদে যাবো বলে ঠিক করেছি।” তিনি বলেন, এটা সহজ বলে নয়, বরং এই কাজটা কঠিন বলেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট কেনেডি ষাটের দশকেরই মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর কথা বলেছিলেন। এবং তার সেই স্বপ্ন সাত বছরের মধ্যেই বাস্তবে পরিণত হয়।
কিন্তু এর কয়েক বছরের মধ্যেই নাসার চন্দ্রাভিযান বন্ধ হয়ে যায়। সংস্থাটির বাজেটে এতো ব্যাপক কাটছাঁট করা হয় যে অ্যাপোলো মিশনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
শুরুতে মোট ২০টি অ্যাপোলো মিশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু চাঁদে অবতরণের পর প্রযুক্তি ও গবেষণা নির্ভর এই মিশন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের কাছে ক্রমশই গুরুত্ব হারাতে থাকে।
ফলে শেষ তিনটি মিশন বাতিল করা হয়। এবং চাঁদে নাসার মিশন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
চন্দ্রাভিযান কেন বন্ধ হয়ে যায়
অ্যাপোলো ১১ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক মিশন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে মহাকাশেও যে তারা শক্তিশালী সারা পৃথিবীর কাছে এরকম একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল চাঁদে যাওয়ার দৌড়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করা। তাতে তারা সফলও হয়েছিল।
নাসার বিজ্ঞানী ড. ঘোষ বলেন, “নাসার প্রথম চাঁদে যাওয়াটা ছিল সামরিক কারণের একটি অংশ। শীতল যুদ্ধের কারণে সেসময় রাশিয়ার সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতা ছিল। সামরিক কারণটা চলে যাওয়ার পর এতো অর্থ খরচ করে চাঁদে মানুষ পাঠানো আর যৌক্তিক বলে বিবেচিত হলো না।”
“তাই আমেরিকা মহাকাশ গবেষণার বাজেট অনেক কমিয়ে দিল। তারা ভাবল আমরা অন্য কোনো সক্ষমতা অর্জন করি,” বলেন তিনি।
চাঁদে যাওয়ার জন্য জেএফ কেনেডি সরকার প্রাথমিকভাবে বাজেট নির্ধারণ করেছিল ৭০০ কোটি ডলার। কিন্তু পরে সেটা ২০০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এতো বিশাল অর্থ খরচ করে চাঁদে মানুষ পাঠানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণেরও খুব একটা সমর্থন ছিল না। কারণ সেসময় দেশটিতে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল।
কিন্তু এখন অর্থ খরচে আপত্তি নেই কেন?
নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন তাদের বর্তমান চন্দ্রাভিযানের পেছনে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মহাকাশের আরো দূরে যাওয়ার স্বপ্ন। বলা হচ্ছে আর্টেমিস মিশনে তারা চাঁদ দেখতে যাচ্ছেন না, এবার তারা সেখানে থাকতে যাচ্ছেন।
নাসার উদ্দেশ্য চাঁদের বুকে একটি ঘাঁটি গড়ে তোলা যেখান থেকে মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালানো হবে।
মহাকাশ বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ বলেন, “চিন্তাধারাটা হচ্ছে- মঙ্গলে যাওয়ার জন্য যে টেকনোলজি তৈরি করতে হবে সেটা চাঁদেই ডেভেলপ করা ভালো। কারণ মঙ্গল চাঁদের চেয়েও বহু গুণ দূরে।”
“যেখানে তিনদিনে পৌঁছানো যাবে, সেখানে গিয়ে আমরা জিনিসটা শিখে নেবো এবং পরে সাত মাসের যাত্রা করে মঙ্গলে পৌঁছাবো।”
অমিতাভ ঘোষ বিশ্বাস করেন, মানুষের পক্ষে চাঁদে থাকা সম্ভব। এজন্য সেখানে শুধু থাকার মতো একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
“আমরা যে অ্যান্টার্কটিকায় থাকি, কী সাহারা মরুভূমিতে থাকি, আমরা থাকি একটা হ্যাবিটেশন মডিউলে। এখানে বিদ্যুৎ আছে। খাবার আছে। চাঁদেও এমন মডিউল তৈরি করা যাবে। সেখানে শুধু অক্সিজেন আর জলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন তিনি।
নাসার একজন প্রশাসক বিল নেলসন বলেছেন, “বর্তমান আর্টেমিস মিশনে নভোচারীরা মহাকাশে এমন এক প্রযুক্তি তৈরি করবে যাতে মঙ্গল গ্রহে প্রথমবারের মতো মানুষ পাঠানো সম্ভব হয়।”
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১০ সালে এই স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, নাসাকে মহাকাশের আরো চ্যালেঞ্জিং গন্তব্য ঠিক করতে হবে। যেতে হবে চাঁদের চেয়েও দূরের কোনো গ্রহাণু এবং মঙ্গল, জুপিটার কিম্বা শনির মতো কোনো গ্রহে।
আজকের আর্টেমিস মিশনের নাম ঠিক করা হয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে।
গ্রিক পুরাণে অ্যাপোলোর যমজ বোন আর্টেমিস।
সেই আর্টেমিসকে এখন পাঠানো হচ্ছে চাঁদের অভিমুখে। আপাতত এতে কোনো নভোচারী থাকবে না। এর ওরাইঅন মডিউল ৪২ দিন ধরে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে। এসময় চাঁদে মানুষ পাঠানোর বিষয়ে বেশ কিছু পরীক্ষাও চালানো হবে।
ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের কোনো এক সময়ে পৃথিবীর মানুষ আবারও চাঁদে পা ফেলবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেটাই হবে চাঁদের চেয়েও দুশো গুণ বেশি দূরে অবস্থিত মঙ্গলের অভিমুখে মানবজাতির প্রথম পদক্ষেপ।
নাসার স্বপ্ন ২০৩০ সালের মধ্যে মঙ্গলে পা ফেলা।
সূত্র: বিবিসি
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel