ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম : এই প্রথম কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে।
বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) কার্যক্রম শুরু হচ্ছে আগামী ৬ এপ্রিল থেকে। টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সৌদি আরব-ভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনা (আরএসজিটিআই)।
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর বিদেশি এ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চুক্তির দিন থেকে ২২ বছর চট্টগ্রাম বন্দরের এ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করবে প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিপাক্ষিক এই চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পেলো বিদেশিরা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রস্তুত। গত ৬ ডিসেম্বর সৌদি আরবভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী রেড সি গেটওয়ে নামের প্রতিষ্ঠানকে পিসিটি পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রতিষ্ঠানটি এখানে যন্ত্রপাতি ক্রয়, জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ শুরু করেছে। আগামী এপ্রিল থেকে এ কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। তবে পুরোদমে চালু করতে আরও সময় লাগবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে পিসিটি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। নতুন নির্মিত এই টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি কনটেইনার জাহাজ ভিড়তে পারবে। পতেঙ্গা এলাকায় নির্মিত এ টার্মিনালের মাধ্যমে বছরে ৫ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে। পাশাপাশি এ টার্মিনালটি বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বাকি টার্মিনাল থেকে এখানে বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যাবে। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ৯ মিটার ড্রাফট ও ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারে। সেখানে পিসিটি’তে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে।
পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান সরকার বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি পিসিটি চট্টগ্রাম বন্দরে বাকি টার্মিনাল থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার কাছে। যে কারণে আসা-যাওয়া মিলে ১৪ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে পিসিটি ব্যবহারকারীদের। এতে সাশ্রয় হবে জ্বালানি ও সময়।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ ভেড়ানো যায় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি)। এখানে সর্বোচ্চ ৯ মিটার থেকে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যায়। সর্বশেষ নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) ভেড়ানো যাবে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। যে কারণে বেশি মালামাল নিয়ে জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। বেশি কনটেইনার নিয়ে বড় জাহাজ ভেড়ার সুযোগ থাকায় খরচ কমবে পণ্য আমদানি-রফতানিতে।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে প্রকল্প এলাকায় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা স্থানান্তরসহ নানা জটিলতার কারণে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। এ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। বন্দরের ড্রাইডক থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত ২৬ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করে সেনাবাহিনীর ৩৪-ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পতেঙ্গা কনটেইনার টামিনালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
দেশের ৯৪ ভাগ আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আবার মূল রফতানি বাণিজ্যের ৯৮ ভাগ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য যে হারে বাড়ছে, তাতে বন্দরে আরও নতুন টার্মিনাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনেক আগেই দেখা দিয়েছিল। পিসিটির ব্যবহার শুরু হলে বন্দরের টার্মিনালের সংখ্যা দাঁড়াবে চারটিতে। অফরদিকে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দরের মূল জেটির সংখ্যা দাঁড়াবে ২১টিতে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপি) টার্মিনাল পরিচালনার বিদেশি অপারেটর নিয়োগে কাজ করছে। সৌদি আরব, দুবাই, ভারত ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পিসিটি পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করে প্রস্তাবনা দেয়। এরমধ্যে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে, দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, ভারতের আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড ও সিঙ্গাপুরের পিএস সিঙ্গাপুর প্রস্তাবনা জমা দেয়। এসব প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই শেষে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালকে অপারেটর হিসেবে নিয়োগে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানা গেছে, রেড সি গেটওয়ে প্রস্তাবে বলেছে, পিসিটি পরিচালনায় ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশি টাকায় দুই হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। নিজেদের অর্থে যন্ত্রপাতি কিনে ২২ বছরের জন্য এই টার্মিনাল পরিচালনার চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানটি। আর চুক্তির দিন থেকে গণনা শুরু হবে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ডেনিম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সহ-সভাপতি সৈয়দ এম তানভীর বলেন, আমদানি-রপ্তানি হ্যান্ডলিং সময় কমানোর মাধ্যমে দেশের বন্দর কার্যক্রম উন্নত হবে। এই উদ্যোগ অন্যান্য টার্মিনাল অপারেটরদের পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন এবং সামগ্রিকভাবে তাদের কর্মক্ষমতা বাড়াবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, এর মাধ্যমে বন্দরে সুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি হবে। যেহেতু বিদেশি অপারেটররা আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করবে এবং পিসিটিতে উন্নত সেবা নিশ্চিত করবে, তাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অন্যান্য টার্মিনালে ওই ধরনের উন্নত সরঞ্জাম ও সেবা নিশ্চিত করতে বাধ্য হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।