নাদিমা জাহান: সুখ বা দুঃখের অনুভূতি ব্যাপারটি যেমন আপেক্ষিক, তেমনই জটিল। যুগে যুগে সুখের পেছনে ছুটছি আমরা। সুখী হতে আসলে কী লাগে, তা–ও কেউ জানে না। কবি-সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিদ, দার্শনিক— সবাই সুখের সংজ্ঞা খুঁজে চলেছেন নিজের মতো করে। গানের কলিতে কেউ বলছেন শত সাধনায়ও সুখ মেলে না, আবার কারও সুরে সুখের জন্য আকুলতা ছুঁয়ে যাচ্ছে হাজারো হৃদয়। অর্থ-সম্পদ থেকে শুরু করে যাপনের যত বিলাসী উপচার—সুখের জন্যই যেন এত আয়োজন। কিন্তু বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সেই ৮৫ বছর ধরে চলে আসা এক গবেষণার ফলাফল বলছে সুখ অতটা অধরা নয়, আর এর রহস্য লুকিয়ে আছে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের অদেখা বন্ধনের মধ্যেই।
এই আলোচিত গবেষণাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭৪২ জন ব্যক্তির জীবনের ওপর করা হয়েছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবনসঙ্গী ও বংশপরম্পরায় তাঁদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিরাও এই গবেষণার অংশ হয়েছেন। বর্তমানে এই অ্যাডাল্ট ডেভেলপমেন্ট স্টাডির নেতৃত্ব দিচ্ছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ মনস্তত্ত্ববিদ ড. রবার্ট ওয়ালডিঙ্গার, যিনি ২০০৩ সাল থেকে এ দায়িত্বে রয়েছেন।
সম্প্রতি সুপরিচিত টেডএক্স বক্তৃতায় তিনি গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে এই সুখের প্রাণভোমরার সন্ধান দিয়েছেন সবাইকে। তিনি বলেন, ‘অর্থ-সম্পদ, খ্যাতি বা শুধুই উন্নতি করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম নয়; বরং ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, সৎ ও আন্তরিক সম্পর্কগুলোই সুখী করতে পারে আমাদের। এটাই শেষ কথা।’
ওয়ালডিঙ্গার ও এই গবেষণায় তাঁর সহযোগী, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মার্ক শালজ মিলে এ নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যার নাম ‘দ্য গুড লাইফ’। তাঁদের মতে, মানুষে মানুষে আন্তরিক আর ভালো সম্পর্ক তখনই সত্যিকারের সুখ দিতে পারে, যখন আমরা অর্জন করতে পারব সোশ্যাল বা সামাজিক ফিটনেস। এই নতুন ধারণাটির ব্যাপারে এখানে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁরা।
শারীরিক বা মানসিক ফিটনেস অনেকটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চেষ্টার মাধ্যমে গড়ে তোলার বিষয়। ওয়ালডিঙ্গার আর শালজের মতে, সামাজিক ফিটনেসও এভাবে অর্জন করতে হবে সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে। শালজের বয়ানে, ‘আমরা মনে করি, সম্পর্ক এমনিতেই হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য দরকার শ্রম দেওয়া, চেষ্টা করা ও বিভিন্নভাবে নিজেকে ডেভেলপ করা। দুজন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতে পারে আপনা হতেই, কিন্তু সে সম্পর্ককে জিইয়ে রাখতে আর বিকশিত করতে প্রয়োজন সচেতন উদ্যোগের।’
কিছু বিষয়কে এই দুই মনস্তত্ত্ববিদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সুখী জীবনের জন্য। এর মধ্যে রয়েছে আপন কোন মানুষের কাছে গেলে নিরাপদ বোধ করা, প্রয়োজনে তাকে সর্বাগ্রে পাশে পাওয়া, একে অপরের প্রতি মমত্ববোধ ও সহানুভূতিশীল হওয়া, একে অপরের উদ্দীপক হওয়া। বন্ধুত্ব হোক, পারিবারিক সম্পর্ক হোক অথবা হতে পারে তা প্রেমের বন্ধন—হাসি, আনন্দ, কৌতুক আর মজার সময় কাটানো এক অত্যন্ত বড় বিষয় সুখী হওয়ার জন্য। আর রোমান্টিক সম্পর্কে আকর্ষণের স্ফুলিঙ্গটি নিভতে দেওয়া যাবে না কোনোক্রমেই, তা বয়স বা সময় যাই হোক না কেন।
অত্যন্ত আলোড়ন তোলা এই বই আর গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে টেডএক্স বক্তৃতাটি আসলে আমাদেরকে জীবনের ব্যাপারে নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে বাধ্য করবে। জীবনে সুখী হতে না পারলে সে জীবনের সার্থকতা কোথায়! মা-বাবা বা সন্তানকে সময় দেওয়া, জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার কথা বলা খুব প্রয়োজন। ভালোবাসার মানুষটির প্রিয় খাবারটি রান্না করা যায়, তার প্রিয় রঙে নিজেকে সাজানো যায়, দিন শেষে একান্ত সময়টুকুতে। ‘ভালোবাসি’ বলে তার হাতটি ধরা যাক অপ্রত্যাশিতভাবে। মাঝেমধ্যে একটি ফোনকল বা ছোট একটি টেক্সট মেসেজই যথেষ্ট। বন্ধুর প্রিয় মুভি বা বই নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা গেল, না হয় সচেতনভাবেই। সুখের জন্য এটুকু তো করাই যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।