জুমবাংলা ডেস্ক : ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মুরাদের যৌন কেলেঙ্কারিতে অনেক শিক্ষকই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে বলে আতঙ্কে ছিলেন। পরে ভিকারুননিসা প্রশাসনের নোটিসে কোচিং বন্ধের ঘোষণা করা হয়। কিছু দিন বন্ধ থাকলেও আবারও স্কুলের শিক্ষকরা কোচিং-প্রাইভেট শুরু করেছেন। স্কুলটির একাধিক শিক্ষক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক বলেন, কোচিং-প্রাইভেটের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে শিক্ষরা চাইলেও এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজ শাখার এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, সরকারের উচিত নীতিমালায় কোচিংয়ের ওপরে কর আরোপ করা। কোনো শিক্ষক মাসে ৫ লাখ আয় করল তাতে যদি আড়াই লাখ টাকা ট্যাক্স দিতে হয় সমস্যা কোথায়? বাকি আড়াই লাখ তো পকেটে থাকল।
বাংলা, ইংরেজি, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন। এই ৫ বিষয়ে কোচিং-প্রাইভেট নির্ভরতা নেই রাজধানীতে এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিক্ষকদের ভালো নজরে, নানা প্রলোভনে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়ে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজও এর ব্যতিক্রম নয়। আর এ সুযোগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রায় শতভাগ শিক্ষক কোচিং প্রাইভেটে ব্যস্ত। এমনো শিক্ষক আছেন যারা দিনে ছয়টি করে ব্যাচ পড়াচ্ছেন। প্রতি ব্যাচে শিক্ষার্থী থাকে ৭০-৮০ জন। একটি ক্লাসে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কি শিখতে পারে তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন রয়েছে। এরপরও শিক্ষার্থী প্রতি গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা নেন এসব শিক্ষকরা। ফলে শুধু প্রাইভেট পড়িয়ে এসব শিক্ষক মাসে ১০ লাখ টাকাও আয় করছেন।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু বলেন, অনেক শিক্ষক আছেন যারা মাসে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা কোচিং-প্রাইভেট পড়িয়ে আয় করছেন। এটি মন্ত্রণালয়ও জানে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শিক্ষায় এমন অস্থিরতা চলতে পারে না। সরকারকে কোচিং বন্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা উচিত।
কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারেন না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন। কিন্তু ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কোনো শিক্ষকই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা করছেন না। উল্টো বছরের শুরুতে স্কুল থেকে একটি রুটিন প্রকাশ করা হয়। এ সময় কে ক্লাস টিচার হবেন, গণিত প্রথম চার মাস কোন শিক্ষক পড়াবেন। পরের চারমাস কে করবেন এ সব প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নির্ধারণ করেন। শিক্ষকরা নানা উপঢৌকন দিয়ে তাদের ম্যানেজ করেন। দেখা যাচ্ছে প্রথম চার মাসে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষকের কাছে, পরের চার মাস অন্য শিক্ষকের কাছে দৌড়াচ্ছেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চার শাখায় ২৫ হাজার ৬০০ ছাত্রী পড়াশোনা করছে। এরমধ্যে কলেজ পর্যায়ের দ্বিতীয় বর্ষে ২৪০০ ও প্রথম বর্ষে ২২৫০ শিক্ষার্থী আছে। এই শাখায় শিক্ষকের সংখ্যা ৭০ জন। যাদের মধ্যে মাত্র ৫ জন রয়েছেন খন্ডকালীন শিক্ষক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলেজ পর্যায়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। যাদের মধ্যে দুই জন খন্ডকালীন শিক্ষক। এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি প্রাইভেট কোচিং করাচ্ছেন সালমা আক্তার। প্রতিদিন গড়ে ৫-৭টি ব্যাচ তিনি পড়ান। প্রতিব্যাচে শিক্ষার্থী রয়েছে ৭০-৮০ জন। একই বিষয়ের মূল শাখার কলেজ শিক্ষক ও গভর্নিং বডির কলেজ শাখার শিক্ষক প্রতিনিধি সহকারী অধ্যাপক ড. ফারহানা খানমের বিরুদ্ধেও কোচিং-প্রাইভেট পড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। তবে তিনি বলেন, ২০১৩-১৪ সালে তিনি পড়াতেন। এখন কলেজ পরিচালনা পর্ষদে থাকায় সময় ও সুযোগ কম। এ কারণে এত বেশি শিক্ষার্থীকে পড়ানো হয় না।
শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য মতে, মাসে ৮-১০ লাখ টাকার বেশি ইনকাম করছেন রসায়ন পড়িয়ে রাফি স্যার। কোচিংয়ে বাংলা পড়ানোতে সব চেয়ে এগিয়ে ইয়াসমিন নাহার ও সুমন স্যার। গণিতে ৫০০-৭০০ শিক্ষার্থী একাই পড়ান মেহেদী হাসান রিয়াজ।
ভিকারুননিসা ঘিরে তিন শতাধিক কোচিং ॥ ভিকারুননিসার চারটি শাখা। এরমধ্যে ধানমন্ডি, আজিমপুর, বসুন্ধরা ও মূলশাখা রয়েছে বেইলি রোডে। এসব শাখা ঘিরে অন্তত তিন শতাধিক কোচিং ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অনেকক্ষেত্রে শিক্ষকরা বাসা ভাড়া করেই শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন।
ধানমন্ডি শাখার আশপাশে ৯টি, আজিমপুরে ৩৫টি, বেইলি রোডে মূল শাখার আশপাশে দুই শতাধিক এবং বসুন্ধরা শাখার আশপাশে অন্তত ৪০ কোচিং সেন্টার রয়েছে বলে জানা গেছে। ভিকারুননিসার আজিমপুর শাখার পাশের ১০৩ নম্বর ভবনে চলে কোচিং ও প্রাইভেট ব্যাচ। সেখানে গোল্ডেন টাচ, প্রত্যাশা একাডেমিক কোচিং ছাড়াও কয়েকটি প্রাইভেট ব্যাচে পড়ানো হয়। আজিমপুর শাখার কাছেই চায়না গলি। সেখানে কমপ্লিট কমার্স, উদয় ক্যাডেট অ্যান্ড একাডেমিক কোচিং, মেধাবিকাশ একাডেমিক অ্যান্ড সেরা স্কুল ভর্তি কোচিং সেন্টার রয়েছে। ভিকারুননিসার মূল শাখার আশপাশে বইঘর গলি, খন্দকার গলি ও কালীমন্দির গলিতে দুই শতাধিক কোচিং সেন্টার রয়েছে। এ ছাড়া বসুন্ধরা শাখায় অধিকাংশ শিক্ষকের বাসায় রয়েছে মিনি কোচিং সেন্টার। শিক্ষকদের বাসার ভেতরে একটি রুমে হোয়াইট বোর্ড ঝুলিয়ে সেখানে বেঞ্চ, টেবিলসহ ক্লাসরুমের আদলে গড়ে তুলেছেন কোচিং সেন্টার। খন্ডকালীন শিক্ষকরা আবার যৌথভাবে বাড়িভাড়া নিয়ে প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়ান।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, আমরা এরই মধ্যে কোচিং প্রাইভেট বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছি। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি করা হবে।
জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারেন না। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানেই এটি মানা হচ্ছে না। মাউশির পক্ষে দেশের লাখ লাখ শিক্ষক কোথায় কোচিং বা ব্যাচে পড়াচ্ছেন, তার খোঁজ রাখা অসম্ভব। তবে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত ‘শিক্ষা আইন’-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে পাঠদান বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করে বর্তমানে এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। সূত্র : জনকণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।