লাইফস্টাইল ডেস্ক : বড়দের ছোট ছোট কাজ শিশুদের মনে ভালোবাসার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। শুধু ভালোবাসাই নয়, শিশুদের নানা অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করাতে পারে বড়দের স্নেহ। বিজ্ঞান বলছে, স্নেহের বশে নানা কাজের কারণে শিশুর মস্তিষ্ক বিকশিত হয়, ডিএনএতে পরিবর্তন আসে এবং স্নেহের প্রকাশ ভাষার বিকাশ, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া, মানসম্মত সম্পর্ক ও পরবর্তীতে জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরির উপযোগী করে মস্তিষ্ককে গড়ে তোলে।
অনলাইন সংবাদমাধ্যম সাইকোলজি টুডের এক প্রতিবেদনে এমন ১০টি কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার ফলে শিশুদের মনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে এবং তাদের মস্তিষ্ক বিকশিত হতে সাহায্য করতে পারে।
১. ভালো ভালো কথা বলা
গবেষণা অনুসারে, নবজাতক অন্যদের গলার স্বরের তুলনায় মায়ের গলার স্বর শুনতে বেশি পছন্দ করে। এ ছাড়া শিশুরা হাসিখুশি কথা শুনতে বেশি পছন্দ করে। তাদের মধ্যে মাতৃসুলভ কথা বা ভাষাগতভাবে সহজ এবং উচ্চ স্বর এবং আদুরে কণ্ঠস্বর পছন্দ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
শিশুদের সঙ্গে সরল ভাষায়, আদুরে কণ্ঠস্বরে পুনরাবৃত্তি করে কথা বললে তাদের ভাষা শিখনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে তারা ভাষার কাঠামো এবং বাক্যের গঠন বুঝতে পারে। যেসব মা একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন, শিশুদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁরা সহজেই নিজের কণ্ঠের ধরন এবং নির্দিষ্ট ভাষার অনন্য স্বর বদলে ফেলতে পারেন।
গবেষণা বলছে, যেসব শিশুর সঙ্গে কথা বেশি বলা হয়, সেসব শিশুর মধ্যে ভাষা–প্রক্রিয়াকরণের দক্ষতা এবং শব্দভান্ডার বেশি থাকে। গবেষকেরা মা–বাবাদের তাই শিশুদের সঙ্গে কাজের ধারাবাহিকতা নিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরবর্তী ধাপে কোন কাজটি করতে যাচ্ছেন সেটি শিশুকে বলা। যেমন: এখন আমরা খাব, এরপর আমরা ঘুমাতে যাব— এভাবে কথা বলা। এতে শিশুর মধ্যে আস্থা তৈরি হয়।
২. চোখে চোখ রেখে কথা বলা
শিশুর চোখে চোখ রেখে কথা বললে বা তাদের দিকে সরাসরি তাকালে তারা বেশ আনন্দিত, শান্ত এবং (সংযুক্ত) বোধ করে। চোখে চোখ রেখে তাকানোর ফলে শিশুর মস্তিষ্কের কিছু অংশ বিকশিত হয় এবং মা–বাবা ও সন্তানের মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের সাযুজ্য তৈরি হয়। এতে শিশুর শব্দভান্ডারও বেড়ে ওঠে।
যেসব মা–শিশুর মধ্যে নিরাপদ সম্পৃক্ততা রয়েছে সেসব শিশু অন্য শিশুর তুলনায় বেশি চোখের দিকে তাকায়। গবেষণা বলছে, মায়ের সক্রিয় চেহারার (মুখভঙ্গি ও হাতের নড়াচড়া) দিকে তাকালে শিশুরা হাসে বেশি এবং শব্দ করে বেশি। এ ছাড়াও শিশুর চোখের দিকে তাকানো এবং মা–শিশুর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ শিশুর মধ্যে নিরাপদ ও শান্ত বোধ তৈরি করে।
৩. শিশুদের জড়িয়ে ধরা
শিশুদের জড়িয়ে ধরলে তারা স্নেহ বোধ করে, চারপাশের সঙ্গে আরও বেশি সম্পর্কিত বোধ করে এবং তাদের মানসিক চাপ কমে আসে। এমনকি এতে তাদের ডিএনএ–এর মধ্যেও পরিবর্তন আসে।
যেসব শিশু মায়ের সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে থাকে তাদের মধ্যে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বোধ করা, পারস্পরিক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া ও সামাজিক আচরণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হওয়ার প্রবণতা বেশি। শিশুর বয়স ৯ বছর বয়স পর্যন্ত এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। এমনকি যেসব মা সরাসরি সন্তানের ত্বকের সংস্পর্শে থাকেন তাঁদের মধ্যেও বিষণ্নতা ও উদ্বেগের পরিমাণ কম থাকে।
শিশু ও লালনপালনকারীর মধ্যে সম্পর্কের নৈকট্য ও সংযোগ শিশুর ওপর অতি সূক্ষ্মরূপে প্রভাব ফেলে, যা কয়েক বছর পর দৃশ্যমান হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু সরাসরি সংস্পর্শ তুলনামূলক কম পেয়েছে তাদের ডিএনএ বয়সের তুলনায় অবিকশিত রয়ে গেছে।
৪. মানিয়ে নেওয়া ও সম্পৃক্ততা
চারপাশের সঙ্গে বন্ধন তৈরি ও সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য অভিযোজন বা মানিয়ে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে মা–বাবা সন্তানের চাহিদা (উষ্ণতা, খাবার, ঘুম ও স্নেহ) বুঝতে পারে এবং তা পূরণ করতে পারে। মানিয়ে নেওয়া বলতে এখানে মূলত শিশুর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে মেনে নেওয়া, শিশু কেমন বোধ করছে বা কেমন প্রতিক্রিয়া করছে তা পর্যবেক্ষণ করা এবং শিশুর যত্নের ক্ষেত্রে কোনো রুটিন বা কাঠামো মেনে চলাকে বোঝানো হয়েছে। শিশুর সঙ্গে স্বাস্থ্যকর অভিযোজন ও সম্পৃক্ততা তাদের মস্তিষ্কের সামাজিক, জ্ঞানীয় ও আবেগীয় অংশকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
গবেষণা বলছে, লালন–পালনকারীরা যখন শিশুর ইঙ্গিতপূর্ণ সংকেতে সাড়া দেয় তখন শিশুর মস্তিষ্কে ইতিবাচক সংযোগ গড়ে ওঠে।
৫. শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করা
শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করলে তা শিশুর বিকাশে সহযোগিতা করে। গবেষক ক্রোল ও কনেলি বলেন, মায়েরা শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করলে শিশুর অক্সিটোসিন সিস্টেম ও ডিএনএতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
শিশুদের নিজের শরীরকে বোঝার জন্য ও নানা ধরনের মোটর দক্ষতা (হাঁটা, দৌড়ানো, লাফানো) অর্জনের জন্য একা একা খেলাধুলা করাও জরুরি।
৬. শিশুকে দেখে হাসা
মা যখন সন্তানকে দেখে হাসে তখন শিশুরা আরও বেশি করে হাসে। চার মাস বয়স থেকেই শিশুরা মাকে দেখে হাসতে শুরু করে। তাদের এ হাসি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকে। মূলত মাকে হাসানোর জন্য শিশুরা হেসে থাকে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। মা যখন প্রথমবার সন্তানকে হাসতে দেখে তখন তার মস্তিষ্কে বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক সক্রিয় হয় এবং ডোপামিন নিঃসৃত হয়।
৭. গান শোনানো
শিশুকে আনন্দদায়ক কোনো গান শোনালে তা শিশুকে শান্ত করে, তাদের খোশমেজাজে করে তোলে এবং এটি তাদের ভাষা শিখতে সাহায্য করে। সংগীতকে প্রায়ই মনের ভাষা বলা হয়, কারণ এর মাধ্যমে মানুষের মনে আবেগ–অনুভূতি তৈরি করা যায় বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সংগীত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
সুখকর ও আনন্দদায়ক গান শিশুদের শান্ত করে তোলে এবং তাদের হৃৎস্পন্দনের গতি কমিয়ে আনে। মা যখন শিশুকে গান গেয়ে শোনায় তখন শিশুরা অভিভূত হয়ে যায় বা মনযোগ দিয়ে তা শোনে। তাদের নড়াচড়া কমে যাওয়া থেকেই এমনটা ধারণা করছেন গবেষকেরা। এক গবেষণা বলছে, ৫ মাস বয়সী শিশু আনন্দদায়ক গান ও বেদনাদায়ক গানের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে।
আরেক গবেষণা বলছে, শিশুরা তাদের প্রথম কয়েক মাসে গানের সুর থেকে ভাষা শেখে এবং ছন্দে ছন্দে ছড়া–কবিতা শেখার মাধ্যমে শিশুরা ভাষা আয়ত্ত করতে শেখে।
৮. পড়ে শোনানো
গবেষণা বলছে, শিশুদের বই পড়ে শোনানোর মাধ্যমে মা–বাবার মানসিক চাপ ও উদ্বেগ হ্রাস পায় এবং উষ্ণতা বোধ ও সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। এ ছাড়াও নিয়মিত বই পড়ে শোনানোর মাধ্যমে শিশুদের ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৯. পারিবারিক নিয়মের চর্চা
পারিবারিক রুটিন ও নিয়মকানুন শিশুর স্বাস্থ্য, প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন ও পারিবারিক সম্পর্ক দৃঢ় করে তোলার সঙ্গে জড়িত। উদ্বেগ ও মানসিক চাপের সময়টাতে এ নিয়মকানুনগুলো তাদের মধ্যে স্থিরতা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসে। রুটিনের ফলে শিশুদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্থিতিশীলতা, সম্পর্কে নৈকট্য এবং প্রত্যেক দিন কী প্রত্যাশা করতে হবে তা গড়ে ওঠে।
১০. শান্ত এবং খোশমেজাজ
মা–বাবার মানসিক দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, দ্বন্দ্ব বা আনন্দ আঁচ করতে পারে শিশুরা। গবেষণা বলছে, মা–বাবা যখন রাগত স্বরে কথা বলে তখন অনেক শিশুর মস্তিষ্কেই বিরূপ প্রভাব পড়ে। যেসব শিশুর মায়েরা মানসিক চাপযুক্ত কাজে ব্যস্ত থাকেন, ওই সব শিশুর শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া মায়ের প্রতিক্রিয়ার মতোই হয়।
মায়ের উদ্বেগ শিশুর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। যেসব মা অপরিচিতদের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় উদ্বিগ্ন বোধ করেন, তাঁদের সন্তানদের অপরিচিতদের প্রতি ভীতি আরও বেশি থাকে এবং তাদের মধ্যে অপরিচিতদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা বেশি থাকে।
শিশুরা আনন্দও বুঝতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর করা এক গবেষণা বলছে, যেসব মানুষ সুখী মানুষদের সংস্পর্শে থাকে তারাও ভবিষ্যতে সুখী থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
শিশুদের সঙ্গে বুঝে শুনে সংযোগ গড়ে তুললে পরবর্তী বছরগুলোতে দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। শিশুদের ইতিবাচক মনোভাব পরবর্তী জীবনের তুষ্টির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া গবেষণা বলছে এ ধরনের শিশুরা শিক্ষা ক্ষেত্রেও সফল হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।