জুমবাংলা ডেস্ক : একশ টাকা দিয়ে করতে হবে অ্যাকাউন্ট। মাসে ৩০ হাজার টাকা আয়। এজন্য দেখতে হবে বিজ্ঞাপন, করতে হবে ক্লিক। মিলবে কয়েক গুণ অর্থ। নগদ কিংবা বিকাশের মাধ্যমে তোলা যাবে লাভের টাকা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন চটকদার বিজ্ঞাপন লিংকে রেজিস্ট্রেশন করে ফাঁদে পড়ছেন দেশের লাখ লাখ তরুণ।
দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার রাজবাড়ীর সাংবাদিক মেহেদী হাসান মাসুদের এক প্রতিবেদন থেকে এমনি তথ্য উঠে এসেছে।
এই ফাঁদে পড়ে অর্থ খোয়ানোর পাশাপাশি মোবাইলে স্ক্যামে ঢুকে বেহাত হচ্ছে অ্যাকাউন্টের আইডি, পাসওয়ার্ড। দেশের জনপ্রিয় পত্রিকা দেশ রূপান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অর্থ পাচার ও পিটিসি ওয়েবসাইটের আড়ালে ভয়ংকর প্রতারণার এসব তথ্য।
চার মাস আগে হাসান বাবু নামে এক ভুক্তভোগী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘ঘরে বসে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন এমন বিজ্ঞাপন দেখে ঃৎঁংঃঢ়ধু১০০.পড়স ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করি। পরে একশ টাকা আয়ের পর দুই হাজার টাকা প্রতারিত হই। কেউ অনলাইনকে বিশ্বাস করবেন না।’
স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটারে ‘অনলাইনে আয়, ঙহষরহব ওহপড়সব সার্চ দিয়ে ৭৫টি গ্রুপ খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে ২-৭০ হাজার সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে ৫-৭০ হাজার সদস্য রয়েছে, এমন ২০টি গ্রুপের সন্ধান মেলে। ২০টি গ্রুপে রয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার সদস্য। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব থেকে বৃহৎ গ্রুপগুলোর পিটিসি প্রতারকের দখল রয়েছে ‘অনলাইন থেকে সহজে ইনকাম করুন, ঙহষরহব ঔড়ন ইধহমষধফবংয, গধশরহম গড়হবু ঙহষরহব ডড়ৎষফরিফব, অনলাইন জব গ্রুপ, ঙঘখওঘঊ ওঘঈঙগঊ, ঘরে বসে আয় করুন অনলাইনে, গধশব গড়হবু ঙহষরহব, ঘরে বসে অনলাইনে আয় করুন সহজেই, ঙহষরহব ঔড়ন, গ্রুপে। দ্রুত ধনী হতে টাকা উপার্জন ও লোভনীয় পোস্টের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে চমকপ্রদ হাজার টাকার বান্ডিলের ছবিসহ পেমেন্ট পেয়েছেন এমন স্কিনশট।’
অনলাইন ইনকাম গ্রুপে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এবি রহমান নামে একজন হাজার টাকার ছবিসহ তিনি প্রতিদিন ৫০০ টাকা আয় করেন উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দেন। তাকে ইনবক্স করলে তিনি ঃৎঁংঃঢ়ধু১০০.পড়স রেফার লিংক দেন। সেখানে ক্লিক করে রেজিস্ট্রেশন করার পর একশ টাকা ডিপোজিট করতে বলা হয়। ০১৯৭৩৭০৯৩ নম্বরে ডিপোজিট-পরবর্তী সময়ে প্রতিদিন ৫টা করে অ্যাড ক্লিক করে ৩০ টাকা জমা হতে থাকে, ১০ দিন পর টাকা উইথড্র দিলে ৫ জনকে রেফার করার নোটিস দেওয়া হয়। দুবার ইনবক্স করার পর ব্লক করে দেয় অ্যাডমিন। গ্রুপগুলোতে প্রতি টেলিগ্রাম, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয় ৩০-৫০ টাকা, কেউ কেউ আইডি পাসওয়ার্ড দিচ্ছেন, পরে এসব আইডি দিয়ে চালানো হয় প্রতারণা। লিংকে ক্লিক করলেই চাওয়া হয় ফোন নম্বর, এরপর অকার্যকর লিংকে বেহাত হয় তথ্য। ফলে পুলিশ প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে পায় না।
অনুসন্ধানে পাওয়া ভৎবব-ংযড়ঢ়৯৯.পড়স, নবহমধষ.ষঃফ, নহ.হড়ৎফভী.পড়স, সংঁ-ঢ়যধৎসধপু.পড়স, পৎুঢ়ঃড়.যধঢ়ঢ়ুংযড়ঢ়ৎ.পড়স, সড়হবুযঁহঃ১৫০.ঢ়,ি ংযড়ঢ়ী১০০ঢ়ৎড়.পড়স, ঢ়ৎড়সড়ঃব১০০হবীঃ.পড়স-সহ ৩৫টি সাইটে রেজিস্ট্রেশন করে একই চিত্র পাওয়া গেছে। এসব ওয়েবসাইট কোনোটি ২ মাস কিংবা কোনোটি ৪ মাস চলার পর বন্ধ করে নতুন নামে ভিন্ন থিম দিয়ে খোলা হয়। গ্রুপে ৫০ হাজার সদস্য রয়েছে, এমন দুই শতাধিক পোস্ট দাতার আইডির মধ্যে শতাধিক অ্যাকাউন্টই ভুয়া পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে ৭০ হাজারের সর্বাধিক সদস্য ঙহষরহব ঔড়ন ইধহমষধফবংয. ‘আয় করতে সহযোগিতা চাই’ এমন স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। নাইম শিকদার নামে একজন ংযড়ঢ়ী.নবংঃ-এ অ্যাকাউন্ট করার অনুরোধ জানিয়ে তার রেফার লিংক দেন, সেখানে ক্লিক করলে ঃযবংযড়ঢ়ী.হবঃ প্রবেশ করি। নাইমের বাড়ি নড়াইল, কলেজ শিক্ষার্থী বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমার রেফারে চার শতাধিক মেম্বার আছে। এর আগে সংঁ-ঢ়যধৎসধপু.পড়স-এ একশ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ১৫ হাজার টাকা জমা করে আজও কোনো টাকা তুলতে পারিনি।’
ছয় লাখের বেশি সদস্য রয়েছে ংযড়ঢ়ী.নবংঃ, ঃযবংযড়ঢ়ী.হবঃ ওয়েবসাইটের বিপরীতে, ওয়েবসাইটটি শপিং ক্যাটাগরির দৃশ্যমান। প্রথম পাতায় ঘড়ি, মোবাইল, পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের ছবি, দাম রয়েছে। রেজিস্ট্রেশন লিংকে ক্লিক করে মোবাইল নম্বর, পরে ওটিপি দিয়ে লগইন করার পর দেখা গেছে অ্যাকাউন্ট অ্যাকটিভ করতে হলে বিকাশ, নগদ ০১৩২৩০৯৩৩৪৪ এবং রকেট ০১৯৮৬৯৫৭৮৬০ নম্বরে দিতে হবে ১০০ টাকা। ৩০০ টাকা ডিপোজিট করলে প্রতিদিন ২০ টাকা নির্ধারিত আয় হবে। ২ হাজার টাকায় ডায়মন্ড প্রিমিয়াম সদস্যের জন্য দেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা আয়ের প্রলোভন। ওয়েবসাইটটির অফিশিয়াল টেলিগ্রাম লিংকে প্রবেশ করে দেখা গেছে, ৯৩ হাজার ৪৪৫ জন সদস্য নিয়মিত সেখানে টাকা ডিপোজিটের স্কিনশট দিচ্ছেন। অ্যাডমিন রয়েছে সাইফুল ইসলাম নামে একজন, ছবি ব্যবহার করা হয়েছে বিল গেটসের, যিনি প্রায়ই গ্রুপটিতে নীতিবাক্য আর স্বাবলম্বী করার প্রলোভন দিয়ে যাচ্ছেন। তার মোবাইল নম্বর জানতে চাইলে তিনি গ্রুপ থেকে রিমুভ করে দেন। ওয়েবসাইটে থাকা নম্বর ০১৯২১৮৮৩৭.. দেওয়া হয়েছে ১২টি সংখ্যার, গাজীপুর, ঢাকা ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে।
ডোমেইন বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান যিড়.রং থেকে ংযড়ঢ়ী.নবংঃ ও ঃযবংযড়ঢ়ী.হবঃ যাচাই করে চীনের শিকাগো ঠিকানা পাওয়া গেছে। অক্টোবর ২৩ তারিখে রেজিস্ট্রেশন ও অক্টোবর, ২০২৪ পর্যন্ত, শপেক্স ডট নেট ২০২৬ পর্যন্ত পর্যন্ত মেয়াদ দেখা যায়। নাইম শিকদার বলেন, বর্তমানে আমাদের ৬ লাখ ৫০ হাজার সদস্য রয়েছে।
আমার রাজ্যের আমিই রানী নামে একটি আইডি থেকে সুফৎবধসফরমরঃধষ.পড়স অ্যাকাউন্ট করার জন্য পরামর্শ দেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে অনেক টাকা আয়ের প্রলোভন দেওয়া হয়। ৫৯৯ টাকা ডিপোজিট করলে তাৎক্ষণিক ২০০ টাকা ক্যাশব্যাক অফার করেন। একই ধরনের ওয়েবসাইট সীবধৎহরহম.পড়স। এ বিষয়ে মাইড্রিম ডিজিটাল ও এমএক্সআর্নিংয়ে থাকা নম্বরে ফোন করলে তারা রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, তিন মাস আগে ট্রাস্টপে নামক একটি ওয়েবসাইটে ১০০ টাকা ডিপোজিট করেছিলাম। দুবার উইথড্র দেওয়ার পর নতুন করে এক হাজার টাকা দিয়ে ১০টি মেম্বার নিই, পরিচিতজনদের অনুরোধ করি অ্যাকাউন্ট করতে। পরে সাইটটি বন্ধ হয়ে যায়।
কলেজ শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান বলেন, ‘এখানে প্রতারিত হয়েই প্রতারক হন অধিকাংশ তরুণ। সরল বিশ্বাসে আমি ফেসবুকে একজনের থেকে রেফার পেয়ে পৎুঢ়ঃড়.যধঢ়ঢ়ুংযড়ঢ়ৎ.পড়স অ্যাকাউন্ট করেছিলাম। একবার ২০০ টাকা উইথড্র দিয়ে ২ হাজার টাকা দিয়ে ২০ মেম্বার অ্যাড করি, পরে আমাকে ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এখন সেই ওয়েবসাইটও বন্ধ, টাকার অঙ্ক কম হওয়ায় এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করিনি।’
রেফার লিংকে ক্লিক করার পর আমার ডিভাইসে ভাইরাস প্রবেশ করার ফলে মোবাইলের নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নেয়। পরে আমার কাছে তিন হাজার টাকা দাবি করা হয় বলে অভিযোগ করেন রাজবাড়ী সরকারি কলেজের রাব্বি হোসেন। তিনি বলেন, এসব ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে হলে মোবাইল নম্বর অথবা মেইল ঠিকানা দিতে হয়। এরপর সেখানে ওটিপি কোড দেওয়ার পর রেজিস্ট্রেশন সফল হয়। এতে মূলত মোবাইলের নিয়ন্ত্রণ নেয় প্রতারক চক্র।
ঢাকার একটি কলেজের শিক্ষার্থী প্রিন্স রবিন পেশায় শিক্ষার্থী, লেখাপড়ার পাশাপাশি অনলাইন থেকে আয় করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোঁজ নিয়ে ঙহষরহব ঔড়ন ইধহমষধফবংয গ্রুপে দেওয়া চটকদার স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সড়হবুযঁহঃ১৫০.ঢ়-িএ রেজিস্ট্রেশন করেন। প্রথমে ১০০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট করার ৫ দিন পর ২০০ টাকা উইথড্র করেন। পরে ৫ হাজার টাকা ডিপোজিট করার পর তাকে ব্লক করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘২০০ টাকা পাওয়ার পর আমিও রেফারের লোভে বিভিন্ন গ্রুপে টাকার ছবিসহ পোস্ট করেছিলাম। আমার অনেক পরিচিতজনদেরও রেজিস্ট্রেশন করার জন্য উৎসাহিত করি। আরও কয়েকটি ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন-পরবর্তী একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছি।’
স্কিল আপারের সিইও সফল ফ্রিল্যান্সার শামিম হোসাইন বলেন, রাতারাতি অনলাইন থেকে আয় করবেন এটা সম্ভব নয়। অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের কাজ করে টাকাপয়সা বেশি আয় করা যায় এটা ঠিক, তবে যেকোনো বিষয়ে তার যথেষ্ট স্কিল থাকতে হবে। মার্কেটপ্লেস বুঝতে হবে। রাতারাতি আয় করার প্রলোভন দেওয়া ধান্দাবাজি-প্রতারণা ছাড়া কিছু না। যেকোনো বিষয়ে দক্ষ হতে ছয়-সাত মাস কেটে যায়। এরপরও আপনি সফল হবেন কি না সেটার গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না।
বুয়েটের সিএসই বিভাগের সাবেক পরিচালক ড. মাহফুজুর রহমানের মতে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে কোনোভাবেই লোভ করা যাবে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কোম্পানি কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করে লাপাত্তা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে ক্লিক করাও বিপজ্জনক হতে পারে, আর ডিপোজিট করা তো চরম বোকামি। অপরিচিত লিংকে ক্লিক করার আগে যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ডিসি, ডিডি তারেক আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা অনলাইন প্রতারণার বিষয়েও কাজ করে থাকি। প্রতারিত হয়ে কোনো ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে সেটি তদন্ত-পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কমিশন সচিব মো. নূরুল হাফিজ বলেন, ‘নির্দিষ্ট কোনো ওয়েবসাইটের তথ্য পেলে সেটি খতিয়ে দেখে বন্ধ করা হয়। আমাদের একটা টিম কাজ করে, যারা ভুয়া ওয়েবসাইট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এমনও হচ্ছে যে, ওয়েবসাইটে প্রতারণার অভিযোগে বন্ধ করা হয়েছে, আবার নতুন নামে সেই প্রতারকরা নতুন করে ওয়েবসাইট খুলে প্রতারণা করছে, আমাদের দৃষ্টিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও বন্ধ করা হয়ে থাকে।’
সূত্র : দৈনিক দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।