জুমবাংলা ডেস্ক: অধিকাংশ সময়ই মানুষ ভুলে যায় যে, তার শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, প্রতিভা ও যোগ্যতা তার নিজের ক্ষমতাবলে পাওয়া নয়; বরং তা মালিকের দান। তিনি দিয়েছেন। চাইলে আবার ছিনিয়েও নিতে পারেন। তাছাড়া মানুষের শক্তি, সুস্থতা ও যোগ্যতার ব্যবহারও আল্লাহ তাআলার দয়া ও তাওফীকের উপর নির্ভরশীল। মানুষের কৃত কল্যাণকর কাজ নিজের শক্তিবলে নয়; বরং দয়ালু ও মহান প্রতিপালকের দয়া ও করুণার কারণেই সম্পাদিত হয়।
রাতের বেলা যে বিষয়টি আমার গভীরভাবে উপলদ্ধি হত এবং আমার দুর্বলতা অস্থিরতা, মানসিক কষ্ট ও বেচাইনি আরো বাড়িয়ে দিত, তা হল, এটা তো আমার সেই পরিচিত ঘর, বছরের পর বছর যেখানে আমি আছি; সেই পরিচিত বিছানা, সবসময় যেখানে আমি বিশ্রাম করি। এখানে চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আছে, ঔষধ আছে, খাবার আছে। সেবার জন্য মানুষ আছে। এরপরও শুধু রাতের অন্ধকার ও নির্জনতা আমার রোগের প্রকোপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তাহলে কবরের অন্ধকার ও নির্জনতায় কী পরিমাণ অস্থিরতা ও একাকিত্ব বোধ হবে। সেখানের সবকিছুই তো অপরিচিত। সেই জগৎ। সেই জায়গা। সেই মাটির বিছানা। যেখানে শোয়ার সুযোগ আর কখনো হয়নি। সেখানে আপন কেউ নেই। কোনো সেবক নেই। কোনো পরিচিতজন নেই। নেই কোনো সহমর্মী। রাতের নির্জনতা ও অন্ধকার যখন মনের মাঝে এ পরিমাণ অস্থিরতা ও বেকারারী সৃষ্টি করে তাহলে কবরের নির্জনতা, অন্ধকার ও একাকিত্ব কীভাবে সহ্য হবে। আর (নাউযুবিল্লাহ, ছুম্মা নাউযুবিল্লাহ) ঐখানে যদি কোনো কষ্টের, কোনো শাস্তির সম্মুখীন হই তাহলে বাঁচার কী উপায় হবে? খুব অস্থির হয়ে বার বার اللهم آنس وحشتي في قبري
দুআটি পড়তাম। সেইসাথে গভীরভাবে উপলদ্ধি হত- শুধু আল্লাহর সাথে হৃদয়ের সম্পর্কই তো কাজে আসবে কবরে। এই সম্পর্ক যাদের নসীব হয়েছে, কোথাও কোনো অবস্থাতেই তাদের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ববোধ হয় না। কিন্তু আমরা তো মাখলুককে মন দিয়ে দিয়েছি। তার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। যদি মাখলুকের সাথে নয়, আল্লাহর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হত তাহলে কবরের নিঃসঙ্গতার আশংকা আর মনে জাগত না। মোটকথা, অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রাতের নির্জনতা উপদেশ গ্রহণের বার্তা নিয়ে আসে। কবরের একাকিত্বের চিন্তা মনের মাঝে জাগিয়ে তোলে।
অসুস্থতা হচ্ছে মৃত্যুর কিনারা। অসুস্থ ব্যক্তি যখন রোগযন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন একটি মাত্র ধাক্কাই যথেষ্ট জীবন- নৌকা থেকে মৃত্যুর নদীতে ফেলে দেয়ার জন্য। জীবনসায়াহ্নের মুহূর্তটাকে ‘জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধ’ বলার ভুল একটা প্রচলন সমাজে আছে। অথচ জীবন আর মৃত্যুর মাঝে কোনো যুদ্ধ হয় না। মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়ে এসে জীবন প্রদীপকে এক ফুৎকারে নিভিয়ে দেয়। হ্যাঁ, এটাকে আশা ও নিরাশা, শংকা ও সম্ভাবনার যুদ্ধ বলা যেতে পারে।
বারবার মনে জাগছিল, রোগের প্রকোপ যদি আরেকটু বেড়ে যায় তাহলে এখনি হয়তো আমার মৃত্যু হতে পারে। মৃত্যুর পর আশপাশের সবাই, আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার স্ত্রী-পুত্র, আমার পরিবার-পরিজন, এই বিশাল পৃথিবীর মানুষেরা আমার কী উপকার করতে পারবে?! আমার সামনে তো তখন আখেরাত, শুধুই আখেরাত। যে আমল শুধু আখেরাতের জন্য করা হয়েছে তাই শুধু কাজে আসবে। দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল ধান্দা মরুভূমির মরীচিকা। মিথ্যা প্রহেলিকা। এতে বিভোর হয়ে আখেরাত ভুলে যাওয়া কত বড় মূর্খতা! কত বড় নির্বুদ্ধিতা! আফসোস! আমরা সবাই এই নির্বুদ্ধিতার মাঝেই ডুবে আছি।
মানুষ খুব দ্রুত অতীতের কথা ভুলে যায়। পবিত্র কুরআনেও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে-
وَ اِذَا مَسَّ الْاِنْسَانَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنْۢبِهٖۤ اَوْ قَاعِدًا اَوْ قَآىِٕمًا فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُ ضُرَّهٗ مَرَّ كَاَنْ لَّمْ یَدْعُنَاۤ اِلٰی ضُرٍّ مَّسَّهٗ .
মানুষকে যখন বিপদ স্পর্শ করে তখন শুয়ে-বসে-দাঁড়ানো অবস্থায় আমাকে ডাকতে থাকে। আর যখন তাকে বিপদ মুক্ত করে দেই তখন এমনভাবে চলে যায় যেন সে বিপদে পড়ে আমাকে ডাকেইনি। -সূরা ইউনুস (১০) : ১২
শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন- ‘অর্থাৎ মানুষ মূর্খতাবশত নিজেই আযাব চাইতে থাকে, কিন্তু যখন বিপদের সামান্য ঝাঁকুনি খায় তখন হতবিহ্বল হয়ে আমাকে ডাকা শুরু করে। মসিবত যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে-বসে-শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ডাকতে থাকে। আর যখন বিপদ সরিয়ে নেয়া হয় তখন সবকিছু ভুলে যায়। তখন আর আল্লাহর কথা মনে থাকে না। সেই গাফলত, সেই উদাসিনতা, সেই পাপাচারে আবার মেতে ওঠে। ইতিপূর্বে যেগুলোর মাঝে সে আকণ্ঠ ডুবে ছিল।
সুখের অবস্থায় তুমি আল্লাহকে স্মরণ কর, বিপদের অবস্থায় তিনি তোমাকে স্মরণ করবেন।
মুমিনের শান হল, সে কখনো আল্লাহকে ভুলে যায় না। বিপদ-আপদে সবর করে আর সুখে-শান্তিতে শোকর করে। মুমিন ছাড়া এই সৌভাগ্য আর কারো ভাগ্যে জুটে না।
আমাদের অনেকেই বিপদ-আপদ ও অসুস্থ অবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে খুব ডাকতে থাকে। মান্নত করে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে, জীবন ধারা বদলে ফেলার সিন্ধান্ত নেয়। আর যখন বিপদ-মুক্ত হয়ে যায় তখন সব অঙ্গীকার, সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়। জীবনটাকে আর বদলানো হয় না। অসুস্থাবস্থায় মুখে যিকিরের যে জীবন্ত উচ্চারণ ছিল, দুআ ও ইনাবাত ইলাল্লাহ্র মাধ্যমে হৃদয়ে যে স্বাদ ও সজীবতার অনুভব ছিল, মনের মাঝে আখেরাতের যে জাগ্রত উপস্থিতি ছিল, সুস্থ হওয়ার পর তার কিছুটা ছোঁয়া, কিছুটা ছায়া থাকলেও দিলের সেই কাইফিয়াত, হৃদয়ের সেই স্বাদ ও সজীবতা আর নেই।
এতে মনের মধ্যে ব্যথা অবশ্যই আছে। তবে গাফলতের এ সামান্য ছায়াপাতও আল্লাহ পাকের অনেক বড় নিআমত। কারণ, আমাদের মত দুর্বলদের জন্য আল্লাহ তাআলার সার্বক্ষণিক স্মরণ সাধ্যের বাইরে। তবে হ্যাঁ, পিছনের অবস্থা একদম ভুলে যাওয়া, সুস্থ হওয়ার পর শুকরিয়া আদায়ের পরিবর্তে অকৃতজ্ঞ হওয়া এবং অতীতের মত আবার পাপাচারে ডুবে যাওয়া- এ ধরনের গাফলত খুবই নিন্দনীয়। পবিত্র কুরআনে এর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এ ধরনের গাফলত ও উদাসীনতা থেকে আমাদের রক্ষা করুন।
হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. -এর কাছে সংবাদ এল, তার অমুক ভাই মারা গেছে। পরবর্তীতে জানা গেল, খবরটি ভুল। সে ভাই এখনো জীবিত আছে। ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. তখন তার ভাইকে চিঠি লিখলেন, প্রথম সংবাদটি যদিও ভুল ছিল, তবুও আমরা তোমার ব্যাপারে মনে করি, মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলা তোমাকে আবার দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যেন প্রথম জীবনের ভুল-ত্রুটির সংশোধন তুমি করতে পারো। তাই তোমার কর্তব্য, নবজীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গণীমত মনে করে তা অহেতুক কাজকর্মে নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে।
কঠিন রোগ-ব্যাধি ও অসুস্থতা থেকে সুস্থ হওয়ার পর মনে মনে এ ধারণাই করা উচিত, আমি মারা গিয়েছিলাম। আল্লাহ তাআলা দয়া ও অনুগ্রহবশত আমাকে পুনরায় জীবন দান করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে বেশি থেকে বেশি ফলপ্রসূ বানানোর চিন্তা করা উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।