জুমবাংলা ডেস্ক : সিলেটে চারটি বড় কোয়ারি সহ অন্তত ১৫টি পাথর ও বালু কোয়ারিতে পাথর ও বালু লুটপাটের মহোৎসব চলছে। প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পরে ও পাথর ও বালুখেকোরা লুটে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকার পাথর। ৫ই আগস্ট প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের প্রথম ১৫ দিনে সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি ও ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে ৩শ’ কোটি টাকার পাথর লুটের তথ্য পেয়েছিল প্রশাসন। এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে গোয়াইনঘাটে পরপর দু’টি মামলা হয়েছিল।
মামলায় আসামি হওয়ার পর থেকে জাফলংয়ের পাথরখেকোরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এখন দিনে ও রাতে জাফলংয়ে চলছে লুট। চার মাসে সিলেটে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার বালু ও পাথর লুট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জানিয়েছেন- গত ১৫ বছর প্রশাসনের তরফ থেকে বালু ও পাথর লুটকারীদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এখন চলছে হরিলুট। সিলেটের শারপিন টিলা।
দেশজুড়ে পরিচিত একটি টিলা। এই টিলার মাজার অংশে এতদিন কেউ হাত দেয়নি। কিন্তু শারপিন টিলার চিহ্ন আর এখন নেই। গত চার মাসে এই টিলা থেকে অন্তত ৬০-৭০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এখন চলছে বালু লুট। প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার বালু লুট করা হচ্ছে। এই টিলায় পাথর লুট নিয়ে ইতিমধ্যে এলাকার স্থানীয় দুইপক্ষের সংঘর্ষ হলেও লুটপাট কমেনি। প্রশাসনের তরফ থেকে অভিযান দেওয়ার পরে ও কোন ভাবে বন্ধ হচ্ছে না পাথর লুট।দেশের বৃহত্তর পাথর কোয়ারি হচ্ছে ভোলাগঞ্জ। সাদাপাথর পর্যটন স্পটের লাগোয়া এই কোয়ারি। এখান থেকে গত চার মাসে অন্তত দুই থেকে আড়াইশ’ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এখনো চলছে লুটপাট।
পাশেই রেলওয়ের বাঙ্কার এলাকা। এটি এতদিন নিরাপদই ছিল। কিন্তু ৫ই আগস্টের পর থেকে অবাধে চলছে বাঙ্কার এলাকায় লুটপাট। বিজিবি’র টহল দলের সদস্যদের নেতৃত্বে বাঙ্কারে লুটপাট করা হচ্ছে। সীমান্ত লাগোয়া জনপদ উতমা পাথর কোয়ারি। এখানে এখন পাথর হরিলুট চলছে বলে জানিয়েছেন উতমা, মাঝেরগাঁও সহ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা। তারা জানিয়েছেন- উতমার রমজান ও স্থানীয় ইউপি সদস্য দিলোয়ার মেম্বারের নেতৃত্বে এসব এলাকায় লুটপাট করা হচ্ছে। আগে ওই কোয়ারিতে লুটপাট চালাতেন জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য হেনা বেগম। পুলিশ, বিজিবি’র নামে উত্তোলিত পাথর থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারি থেকে অবাধে লুট করা হচ্ছে পাথর। ইতিমধ্যে এ কোয়ারি থেকেও শতকোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন- হাদাপাড় এলাকার ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা। তারা জানিয়েছেন- স্থানীয় ব্যবসায়ী মাসুক, জসিম ও জয়নালের নেতৃত্বে এ কোয়ারির পাথর লুট করা হয়। এ নিয়ে কয়েকদিন আগে প্রশাসনের তরফ থেকে অভিযান চালানো হলেও পাথর ও বালু লুট বন্ধ হয়নি।
জাফলং পাথর কোয়ারিতে বালু-পাথর লুটের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দু’টি মামলা করা হয়েছে। এ দু’টি মামলায় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন, জেলা বিএনপি’র পদ স্থগিত যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহ্পরাণ সহ শতাধিক লোকজনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ট্রাকশ্রমিকের নামে জাফলংয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। গত শুক্রবার স্থানীয় কান্দুবস্তি ও নয়াবস্তির বাসিন্দারা লুট হওয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা জানিয়েছেন- অন্তত ১০টি এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এখন আর বাঁধের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে ভারতের ঢল নামলেই এসব গ্রামে বসবাস করা দায় হয়ে পড়বে। জাফলং এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন- এখন নতুন করে জিরো পয়েন্ট ও জুমপাড় এলাকায় পাথর লুটপাট করা হচ্ছে। আর এই লুটপাটের কারণে পানবাগান সহ কয়েকটি স্থাপনা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
খবর পেয়ে গতকাল দিনে প্রশাসনের তরফ থেকে অভিযান চালানো হলেও রাতের বেলা ফের লুট শুরু করে বালু ও পাথরখেকোরা। এদিকে বুধবার সিলেটে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার আয়োজনে ‘সিলেটে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা’- শীর্ষক এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সেখানেও আলোচিত হয় পাথর ও বালু লুটের ঘটনাবলী। বেলার তরফ থেকে জানানো হয়েছে- রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সিলেটে টিলা, নদী, এমনকি পর্যটনস্থল থেকে পাথর উত্তোলন বেড়েছে।
এ পাথর উত্তোলনে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যা ভূ-প্রকৃতিকে বড় ঝুঁকিতে ফেলবে। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে ছিলেন- শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. মিছবাহ উদ্দিন, পেট্রোলিয়াম ও খনি প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম। মিছবাহ উদ্দিন বলেন- পাথর কোয়ারিগুলো থেকে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে অবৈধভাবে লাগামহীন পাথর উত্তোলনে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা গবেষণা করা প্রয়োজন।
পাথর কোয়ারিকেন্দ্রিক পর্যনটনশিল্প ও পাথর উত্তোলনের রাজস্ব কেমন- এ দু’টি বিষয়ে তুলনামূলক গবেষণা ও জরিপ প্রয়োজন। কোনটা থেকে সরকার রাজস্ব বেশি পাচ্ছে। পর্যটন খাতে বেশি রাজস্ব আয় হলে তা সমৃদ্ধ করার জন্য সরকারকে সেই খাতে গুরুত্ব দিতে হবে। আরেক বিশেষজ্ঞ শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন- পাথর উত্তোলন না করলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়; কিন্তু বাস্তবে এটি অজুহাত। জাফলংয়ের নদীতে পাথর জমে থাকায় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক রয়েছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হলে প্রশাসনকে আর অভিযান জোরদার করতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।