জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) আরবিট্রেশন সেলে গত বছর করা দেড় হাজারের বেশি অভিযোগ ঝুলে আছে। এতে বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হওয়া বেশির ভাগ বাংলাদেশি কর্মীই কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
বিদেশ গিয়ে প্রবাসী কোনো কর্মী প্রতারিত হয়ে ফিরে এলে এই আরবিট্রেশন সেলে অভিযোগ করা যায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব প্রবাসী কর্মী অভিযোগ করে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন।
অনেক ক্ষেত্রে এক বছর পরও অনেক অভিযোগের বিষয়ে নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
বিএমইটি সূত্র বলছে, গত বছর দুই হাজার ৩৮০ জন প্রবাসী বিএমইটির আরবিট্রেশন সেলে অভিযোগ করেন। এর মধ্যে মাত্র ৮৬৫টি অভিযোগের নিষ্পত্তি করে এই সেল। অর্থাৎ এক হাজার ৫১৫টি অভিযোগ এখনো ঝুলে আছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মকর্তাদের ইচ্ছার অভাবেই বিচার পাচ্ছেন না প্রতারিত প্রবাসীরা। তবে এ জায়গায় পরিবর্তন এলে প্রতারিত হওয়া প্রবাসীরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।
ভুক্তভোগীরা যা বলছেন
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার উত্তর বালাখণ্ডের বাসিন্দা আশিস মণ্ডল ২০২৩ সালের ২ মার্চ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরব যান। রিক্রুটিং এজেন্সি গ্রিনল্যান্ড ওভারসিজ।
এতে তাঁর তিন লাখের বেশি টাকা খরচ হয়। কিন্তু তাঁর কাগজপত্রে ত্রুটি পাওয়ায় দেশটির দাম্মাম বিমানবন্দর অভিবাসন থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়। ফিরে এসে গত বছরের ১০ মার্চ তিনি বিএমইটিতে যান।
গত বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে আশিস মণ্ডল বলেন, ‘আমি বিএমইটিতে যাওয়ার পর ওরা সব কিছু শুনে বলল, আপনি আপনার টাকা পাবেন। এখন বাড়ি যান।
কাজ হওয়ার পর আমরা আপনাকে জানাব। কিন্তু এক বছর পরও কিছু জানায়নি তারা।’
অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে আশিস মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সৌদি যাওয়ার সময় দালালকে দিয়েছি তিন লাখ টাকা। পুলিশ ভেরিফিকেশন, মেডিক্যাল—এসব মিলিয়ে খরচ ৫০ হাজার টাকা। সৌদিতে পাসপোর্ট রেখে দিয়েছিল। এটি ছাড়াতে লেগেছে ১৫ হাজার টাকা। যাওয়ার সময় দূতাবাস থেকে একটি কাগজ দেওয়া হয়। এই কাগজ না দিয়েই আমাকে পাঠানোর ফলে এত বিপত্তি।’
তিনি বলেন, ‘পরে দালালকে ফোন দিয়েছি, কিন্তু দালাল বলে যে ভিসা ও টিকিটের টাকা পাব না। কিছু টাকা ফেরত পাব। কিন্তু দালাল তো কোনো টাকাই দেয় না। এখন তাকে ফোন দিলেও ধরে না।’
অভিযোগের বিষয়ে বিএমইটি
বিএমইটি বলছে, গত বছর ৮৬৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করে চার কোটি ৮৭ লাখ ৯১ হাজার ৯৮০ টাকা আদায় করা হয়।
এর আগে ২০২২ সালে বিএমইটিতে এক হাজার ২৪০টি অভিযোগ পড়ে। সে জায়গায় নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৩৩৯টি। এসব অভিযোগ থেকে এক কোটি ৬০ লাখ ১৮ হাজার ৭০০ টাকা আদায় করা হয়।
বিএমইটি থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে অভিযোগের হার বেড়েছে ৪৭.৮৯ শতাংশ। নিষ্পত্তির হার বেড়েছে ৬০.৮০ শতাংশ। ২০২৩ সালে নিষ্পত্তির হার বাড়লেও তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৬৩.৬৫ শতাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি।
দিনের পর দিন হয়রানি
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের সাইফুল ইসলাম গত বছরের মার্চে রিক্রুটিং এজেন্সি পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যান। সেখানে এক হাজার ৫০০ রিঙ্গিতে অফিস ক্লিনার হিসেবে তাঁর কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁকে মাত্র ৩০০ রিঙ্গিতে একটি পোশাক কারখানায় কাজ দেওয়া হয়। এই বেতনও নিয়মিত পাননি সাইফুল। এতে বেশির ভাগ সময় বাড়ি থেকে টাকা পাঠিয়ে তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সব মিলিয়ে সাইফুলের পরিবারের খরচ হয় প্রায় ছয় লাখ টাকা। এ বিষয়ে বিএমইটি আরবিট্রেশন সেলে ওই রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে কয়েক দফা অভিযোগ দিয়েও কোনো সমাধান পাননি সাইফুল।
সাইফুলের বাবা হেলাল উদ্দিন গত বছরের অক্টোবরে বিএমইটি বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। এতে তিণি উল্লেখ করেন, সাইফুলের সঙ্গে মালয়েশিয়ার কম্পানি দুর্ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন সময় হুমকি-ধমকি দেয়। সাইফুলের জন্য তিনি মোটা অঙ্কের টাকা পাঠানোর বিষয়ও উল্লেখ করেন। কিন্তু পাঁচ মাস পরও এই অভিযোগের বিষয়ে বিএমইটি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এ বিষয়ে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি প্রথমে তিন মাস বিএমইটির বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে ধরনা দিয়েছি। যার কাছে যাই, তিনিই বলেন পরে আসেন। তিন মাস পর গত জানুয়ারিতে তারা রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকর্তাদের ডাকে। ওই সময় রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে বলা হয়, ১৫ মার্চের মধ্যে আমার ছেলের চাকরি পরিবর্তন করে দেওয়া হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পর আরো ১০ দিন পেরিয়ে গেছে, এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো এখন রিক্রুটিং এজেন্সি ও বিএমইটি কেউই কোনো যোগাযোগ করে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমইটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যখন কোনো রিক্রুটিং এজেন্সিকে এই অভিযোগের কথা বলি, তখন তারা নানা ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে। এতে অনেক অভিযোগের নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। কিছু ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সি নিজেই অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্ব নেয়। তখন আর খোঁজ নেওয়া হয় না। প্রবাসীরাও এসে জানান না যে ঝামেলার নিষ্পত্তি হয়নি।’
এই সেলের দায়িত্বে থাকা বিএমইটির কর্মসংস্থান শাখার পরিচালক ছাদেক আহমেদ বলেন, ‘আমাদের শাখা থেকে প্রবাসীদের অভিযোগ নিয়ে কাজ করা হয়। এই শাখায় এসেছি খুব বেশিদিন হয়নি। তাই এ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারব না।’
এ ব্যাপারে অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর পরিচালক মেরিনা সুলতানা বলেন, ‘বিএমইটি আরবিট্রেশন সেলে যে পরিমাণ অভিযোগ পড়ছে, সে অনুযায়ী নিষ্পত্তির কৌশলে একটি বড় ঘাটতি রয়েছে। এটাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তি করার জন্য যে লোকবল প্রয়োজন, তা বিএমইটিতে নেই। এই জায়গাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই জায়গাটার মধ্যে একটা পরিবর্তন এলে আমাদের প্রতারিত হওয়া প্রবাসীরা অন্তত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন।’
তিনি বলেন, ‘এটাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা গেলে অনেক বেশি দ্রুত কাজ করা যেত। তাহলে জেলা পর্যায়ে প্রচুর অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়ে আসত।’ সূত্র : কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।