জুমবাংলা ডেস্ক : এক বা দুই নয়, গভীর মনোযোগের সঙ্গে গুনে গুনে ২৪০ থেকে ৩৫০টি পর্যন্ত সংখ্যা প্রবেশ করাতে হবে ‘কী প্যাড’-এর মাধ্যমে। সব ঠিকঠাক হলে তবেই একজন প্রিপেইড গ্রাহক তার বিদ্যুৎ বিল দিতে পারবেন। কোনো কারণে যদি সামান্য হেরফের হয় তাহলে নতুন করে আবার নামতে হবে সংখ্যা প্রবেশ করানোর যুদ্ধে। অসাবধানতাবশত দুবার ভুল নম্বর প্রবেশ করালে অ্যাকাউন্টটি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্লক হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ বিল রিচার্জ করতে তাকে ওই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর হতে যাওয়ার এই সময়ে বিদ্যুৎ বিলের টাকা রিচার্জ করতে এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অসংখ্য গ্রাহক।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো অবশ্য বলছে, ধীরে ধীরে গ্রাহকের মিটারগুলো স্মার্ট মিটারে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা শেষ হলে এমন সমস্যা আর ধাকবে না। সরকারের পরিকল্পনা হলো-২০২৬ সালের মধ্যে সকল গ্রাহককে স্মার্ট মিটারের আওতায় আনা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন চলছে খুবই ধীরগতিতে। অগ্রগতি বলছে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তো নয়ই বরং কবে নাগাদ সব গ্রাহক স্বস্তিতে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারবেন সেই নিশ্চয়তাও দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কক্সবাজারের বাহারছড়া এলাকার একজন প্রিপেইড গ্রাহক মিনহাজুল ইসলাম সম্প্রতি তার বাসার বিদ্যুৎ বিল দিতে গিয়ে বিশাল সংখ্যা প্রবেশ করানোর তীক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন কাছে। তিনি বলেন, ‘এর আগে প্রিপেইড মিটারে বিদ্যুৎ বিল রিচার্জ করতে ২০ সংখ্যার ডিজিট প্রবেশ করাতে হতো। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার যখন রিজার্জ করতে যায় তখন ২৪০ সংখ্যার ডিজিট আসল। প্রথমে আমি তো অবাক। এতগুলো সংখ্যা ইনপুট (প্রবেশ) করানো খুবই কঠিন কাজ এবং বিরক্তিকর। প্রথমে কয়েকটা সংখ্যা প্রবেশ করানোর পর তো ভুল হয়ে গেছে। দুবার সংখ্যা ভুল করার কারণে আমার অ্যাকাউন্টটি ২৪ ঘণ্টার জন্য ব্লক হয়ে গেল। যখন ব্লক উঠল তখন কাগজ কলম নিয়ে বসলাম। ২০টা করে সংখ্যা প্রবেশ করানোর পর সেটা লাল কালি দিয়ে কেটে আবার নতুন ২০টি সংখ্যা প্রবেশ করালাম। এভাবে ১২ বারে ২০টি করে মোট ২৪০টি সংখ্যার প্রবেশ করানোর একপর্যায়ে আমি সফল হই। এজন্য অনেক সময় লেগে যায়।’
তিনি আরও বলেন, “আধুনিক এই যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশে এটা তো খবুই হাস্যকর। এর ফলে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে আমাদের। যত দিন যাচ্ছে সবকিছু স্মার্ট হচ্ছে। সেখানে বিদ্যুৎ বিল দিতে এত বড় নম্বর!….পরে আমি স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে বিষয়টি আলাপকালে তারা জানালেন আপনার তো ২৪০, কারো কারো ৩৫০ থেকে ৩৬০টি সংখ্যাও প্রবেশ করাতে হয়।’
একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর হয়রানির শিকার হয়েছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচল এলাকার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন গ্রাহক মতিন আব্দুল্লাহ। তিনি জানান, ‘বিদ্যুৎ বিল দিতে গিয়ে গত বছর একবার এবং এ বছরের শুরুতেই আরেকবার এমন বড় সংখ্যা প্রবেশ করানোর ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। সংখ্যাগুলো প্রবেশ করানোর সময় অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। আধুনিকতার এই যুগে এটা খুবই বেমানান। তাছাড়া আমাদের দেশে অনেকেরই প্রযুক্তি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই। তাদের জন্য এটা আরও কঠিন কাজ।’
কেন এত বড় সংখ্যার প্রয়োজন হচ্ছে তা জানতে বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির অন্তত চারজন প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, মোবাইল কিংবা অ্যাপসের পাশাপাশি ২০ সংখ্যার ডিজিট দিয়েই প্রিপেইড গ্রাহকেরা সাধারণত তাদের বিদ্যুৎ বিল জমা দেন। কিন্তু অনেক সময় বিদ্যুতের ট্যারিফ বা মূল্য পরিবর্তন, লোড বৃদ্ধি, নতুন সংযোগ কিংবা কোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন হলে তখনই গ্রাহককে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আবার বছরের শুরুতেই এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এত বড় সংখ্যা ব্যবহারের কারণ হলো- একেকটি সংখ্যা দিয়ে গ্রাহকের নাম, ক্যাটাগরি ইত্যাদি তথ্য বোঝায়। সাংকেতিক এই লেখাগুলো জমা হয় বিতরণ কোম্পানিগুলোর সার্ভারে। নতুন করে কোনো তথ্য হালনাগাদের প্রয়োজন না হলে ২০ সংখ্যার ডিজিট দিয়েই রিচার্জ করা যায়। এর পাশাপাশি মিটারের সঙ্গে কোনো কারণে সার্ভারের যোগাযোগ বিঘ্ন হলেও এমন সমস্যা দেখা দেয়।
গ্রাহকের এমন হয়রানি থেকে মুক্তি মিলবে কবে তা জানতে চাইলে পিডিবির একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলেন, আমাদের প্রায় ৩৭ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহক রয়েছেন। ধীরে ধীরে সব গ্রাহককে স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রথম দফায় সাড়ে ১০ লাখ স্মার্ট মিটার বসানোর প্রকল্প শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ২ লাখ মিটার তাদের হাতে এসেছে। আরও ৮৫ হাজার আমদানিকৃত মিটার বন্দরে পৌঁছেছে। সপ্তাহখানেক পর আরও ১ লাখ ১৬ হাজার মিটার দেশে এসে পৌঁছাবে। মার্চ মাস থেকে পুরোদমে এসব মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হবে।
আগামী ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও অবশিষ্ট মিটারগুলো কবে কেনা হবে তা এখনও নিশ্চিত হয়নি।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৬৩ লাখ। এর মধ্যে শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ৫৫ লাখেরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে মাত্র ৫ লাখ স্মার্ট মিটার স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রাথমিক অবস্থায়। কিন্তু এর অগ্রগতি সামান্য। ধীরে ২ কোটি গ্রাহকের আঙিনায় এই মিটার স্থাপনের লক্ষ্য রয়েছে বলে জানিয়েছে আরইবি।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) আওতাধীন এলাকায় সাড়ে ৮ লাখ স্মার্ট মিটার স্থাপনের প্রকল্প শুরু হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে এই কাজ শেষ করার কথা।
প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শেখ মো. জিয়াউল হাসান বলেন, ‘ইতিমধ্যে ১ লাখ ৩৫ হাজার মিটার স্থাপন করা শেষ হয়েছে। আরও সাড়ে ৫ লাখ মিটার বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। বাকিগুলোও ধীরে ধীরে আমদানি ও স্থাপন করা হবে। এর ফলে গ্রাহক আরও উন্নত ও আধুনিক সেবা পাবেন।’
এছাড়া অপর তিন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো) তাদের বিতরণ এলাকায় স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অপচয় ও চুরি রোধসহ গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা নিশ্চিত করতেই স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপনের এমন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বর্তমানে বিদ্যুতের প্রিপেইড গ্রাহকেরা ঘরে বসেই অনলাইনে ওয়েবসাইটে, মোবাইল ফোনে মিটার রিচার্জ করছে এবং ডিজিটাল ওয়ালেট যেমন বিকাশ, রকেট ইত্যাদির মাধ্যমে বিল পরিশোধ বা মিটার চার্জিং এর সুবিধা পাচ্ছে। এতে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি বিতরণ কোম্পানির কাজেও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে। স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হলে এসব সুবিধা আরও বাড়বে। নানারকম অযাচিত হয়রানি, ভোগান্তিও কমবে। স্মার্ট মিটার স্থাপনের ফলে এর সাহায্যে খুব সহজেই রিচার্জ করা যাবে।
বর্তমানে বিদ্যুতের প্রিপেইড এবং পোস্টপেইড এই দুই ধরনের গ্রাহক রয়েছে। পোস্টপেইড অনেক গ্রাহকের আঙিনায় এখন পর্যন্ত পুরনো আমলের অ্যানালগ মিটার ব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক এলাকায় রয়েছে ডিজিটাল মিটার। প্রিপেইড মিটার হলো এক ধরনের বৈদ্যুতিক মিটার যাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে আগে থেকে জমা করা টাকা ধীরে ধীরে কেটে নেওয়া হয়। টাকা শেষ হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় টাকা রিচার্জ করলে চালু হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ। এই প্রিপেইড মিটার আবার দুই ধরনের। একটি স্মার্ট কার্ড ও কী প্যাডে প্রিপেইড মিটার।
সূত্র : দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।