জুমবাংলা ডেস্ক : মাঘের ভোর, চারিদিকে নিস্তব্ধতা। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো ঘুমন্ত গ্রাম। এমন আবহে মেঠোপথ ধরে ছুটে চলেন কিছু মানুষ; তাদের আমরা ‘গাছি’ বলেই ডাকি। শরীরে প্যাঁচানো দড়ি। কোমরে বাঁশের ঝুড়ি, ভেতরে বাটাল-হাঁসুয়া। শরীরে ঝুলিয়ে রাখা মাটির হাঁড়ি নিয়ে তরতর করে বেয়ে ওঠেন খেজুর গাছে। খালি পাত্রটি বেঁধে দিয়ে নামিয়ে আনেন রসে টইটম্বুর হাঁড়ি।
শীতের মৌসুমে খেজুর রস সংগ্রহের দৃশ্য গ্রাম বাংলায় খুবই সাধারণ ঘটনা। টাটকা রসের স্বাদ পেতে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে গাছিদের কাছেই ভিড় করেন মানুষ। খেজুরের রস খাওয়ার পাশাপাশি রসের হাড়ি নিয়ে ছবিও তোলেন অনেকে। সেসব কেচ্ছা-কাহিনী এখানে না-ই বা বললাম। কিন্তু কীভাবে খেজুর রস সংগ্রহের রেওয়াজ এলো বাংলায়; সেই কাহিনি জেনে নেয়া প্রয়োজন।
১৭৮৭ সাল থেকে শুরু…
বাংলাদেশে খেজুর রস ও চিনির ইতিহাস বহু পুরোনো। বিভিন্ন নথিপত্রে জানা যায়, ১৭৭০ সালের পর যশোর অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। তখন থেকেই মূলত খেজুর রস সংগ্রহের প্রচলন শুরু হয়। ১৮৭৬ সালের বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে খেজুর রস সংগ্রহ ও চিনি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৭৯২ সালের যশোর কালেক্টরেট ভবনের একটি পরিসংখ্যান সারণিতে লিখা ছিল, ‘১৭৯১ সালে ২০ হাজার মণ চিনি উৎপাদন হয় এবং এর প্রায় অর্ধেক রফতানি হয় কলকাতায়। এছাড়া বেতের চিনিরও যথেষ্ট উৎপাদন ছিল।’
১৮১৩ সালে খেজুরের গুড় পাঠানো হয় ব্রিটেনে
দ্য ডেট সুগার ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৮১৩ সালে প্রথমবারের মতো খেজুরের গুড় ব্রিটেনে পাঠানো হয়। এই গুড়ের চাহিদা পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশ রমরমা ছিল। সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যে একচেটিয়া প্রবেশের কারণে চিনিশিল্পও ভালোভাবে এগোতে থাকে।
চিনি শিল্পের ব্যাপক প্রসার বাড়াতে সেই সময়ে রাস্তা, নদী ও খালের ধারে হাজার হাজার খেজুরের গাছ রোপণ করা হয়। মূলত এরপরই অনেকেই ‘গাছি’ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন নিজেদের। এমনকি তখন সবার বাড়িতেই কয়েক রকমের দা, নলি, দড়ি, খোছানো কাঠি, গোঁজ ইত্যাদি থাকতো।
একসময় প্রধানতম আবাদ ছিল খেজুর রস
বাঙালি ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৯০০-০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মণ, যা প্রায় ৮২ হাজার টনের সমান। উল্লেখ্য যে, একশত বছরের খেজুর রসের পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৯৮ শতাংশের বেশি।
১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনার হাওড়া, মেদিনীপুর এবং বাংলাদেশের যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুরে এ শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। তৎকালীন সময়ে প্রতিবছর মোট এক লাখ টন গুড় উৎপাদিত হতো। সেই সময়ে, এক বিঘা জমিতে ১০০টি গাছ লাগানো হতো।
সেই সময়ে বৃহত্তর যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে চাষিদের প্রধানতম আবাদ ছিল খেজুর রস। শীতকালে সেখানকার জীবনযাত্রাই ছিল যেন খেজুর গাছকেন্দ্রীক। পথে-মাঠে-ঘাটে-হাটে সবত্র যেন সাজ সাজ রব। খেজুরের রসে ভেজা, গুড়-পাটালিতে রাঙানো ছিল সবার জীবন। ওদিকে আড়তদাররা বড় বড় পাল্লা বসিয়ে বিকিকিনি করত গুড়ের।
যখন গাছ লাগানো হতো তার সাত বছরের মধ্যে গাছগুলো ফল ও রস সংগ্রহের উপযোগী হতো। অন্তত ত্রিশ/চল্লিশ বছর পর্যন্ত সেসব গাছ থেকে চলত ফল ও রস সংগ্রহ। ১৯৫০ সালের পর ঢালাওভাবে খেজুর গাছ লাগানোর উদ্যোগ দেখা যায়নি। মূলত জমিতে খেজুর গাছ লাগালে আয় মাত্র তিন মাস, কিন্তু অন্য ফসল থাকে বারো মাস। এ জন্যই গাছের পাশাপাশি গাছিদের সংখ্যাও কমছে। কমছে খেজুর রসের উৎপাদনও।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।