আব্দুল হামিদ : যেখানে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে, সেই জায়গাকে হটস্পট বা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলা হয়। সম্প্রতি ছিনতাইকারী ও ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে রাজধানীতে ২৮টি হটস্পটসহ মোট শতাধিক স্পট চিহ্নিত করেছে মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এসব জায়গাসহ পুরো মহানগরে ছিনতাই ঠেকাতে ডিএমপি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এতে অন্য বছরের তুলনায় ছিনতাইয়ের ঘটনা কমেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। ছিনতাই রোধে বিশেষভাবে ১৫ কৌশল নির্ধারণ করেছে ডিএমপি। এ ছাড়া ব্যবসায়ীসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ পরিবহনের ক্ষেত্রে ‘মানি এসকর্ট’ সুবিধা চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আর্থিক ছিনতাই আরও কমে আসবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
ডিএমপির এক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, মহানগরে ছিনতাই রোধে অপরাধপ্রবণ স্পটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কৌশলগুলো জানার চেষ্টা করেছি। সেসব বিষয়কে সামনে রেখে ছিনতাই প্রতিরোধে কাজ করছে ডিএমপি। এদের মধ্যে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকার অপরাধে চাকরিচ্যুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
ডিএমপির মাসিক অপরাধ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এ বছরের প্রথম এক মাস ১৫ দিনে ১৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের প্রথম দুই মাসে ঘটে ৩৪টি এবং ২০২২ সালের প্রথম দুই মাসে ২৬টি। ছিনতাইয়ের শিকার অধিকাংশ ব্যক্তি পথচারী।
গত বছরের ১ জুলাই ঈদের ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি থেকে গাড়িতে ঢাকায় ফেরেন পুলিশ সদস্য মো. মনিরুজ্জামান। ফার্মগেট থেকে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে সেজান পয়েন্টের সামনে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। ওই ঘটনায় চার ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ এলাকায় ছিনতাইকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০২২ সালের ২৭ মার্চ ভোরে শেওড়াপাড়া এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন চিকিৎসক বুলবুল আহমেদ।
ছিনতাইকারীদের হাতে খুনের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছিনতাই প্রতিরোধে সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর ডিএমপি সদরদপ্তরের উপকমিশনারকে (অপরাধ বিভাগ) সভাপতি করে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে ছিনতাইকারীরা কখন, কোথায়, কোন প্রক্রিয়ায় ছিনতাই করে সেসব তথ্য সংগ্রহ, প্রতিরোধ এবং ছিনতাইয়ে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে ডিএমপির সব ইউনিটকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদকের হাতে আসা সেই চিঠিতে দেখা গেছে, সাতটি পদ্ধতিতে ছিনতাই প্রতিরোধ কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে ছিনতাইয়ে টার্গেট ব্যক্তি, স্থান, কৌশল, প্রতিরোধ ও পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে।
ছিনতাইয়ের স্পট
রাজধানীতে শতাধিক স্পটকে ছিনতাইকারীদের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকপাড়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এলাকা, বাসস্ট্যান্ড, স্টপেজ, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, ধানমন্ডি লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তিতুমীর কলেজ, ঢাকা কলেজ, বাঙলা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ। এ ছাড়া বিমানবন্দর এলাকা, বিমানবন্দর রেলস্টেশন, বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকা, গুলিস্তান, সদরঘাট, বেড়িবাঁধ, ৩০০ ফুট, উত্তরা দিয়াবাড়ীসহ রাজধানীর সব ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে টাস্কফোর্সের তথ্যে উঠে এসেছে।
ছিনতাইয়ে টার্গেট যারা
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা উত্তোলনকারী, ভোরে চলাফেরা করা ব্যক্তি, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বের হওয়া ব্যক্তি, রমজান মাসে ইফতারের আগে ও জুমার নামাজ পড়তে বের হওয়া ব্যক্তি, লেক ও পার্কে ঘুরতে বের যাওয়া দর্শনার্থীরা, গাড়িতে বসে মোবাইলে কথা বলা ব্যক্তি, গাড়ির জন্য অপেক্ষারত সাধারণ মানুষদের মধ্যে ভাড়া শেয়ার করায় আগ্রহী ব্যক্তি, জুয়েলারি ব্যবসায়ী, প্রবাসী, ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারকারী এবং রাতে রিকশা ব্যবহারকারীদের বিশেষভাবে টার্গট করছে ছিনতাইকারীরা।
ছিনতাই ঠেকাতে পুলিশের কৌশল
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা সচল রাখা, এসব প্রতিষ্ঠানের পাশে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি করা, ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা উত্তোলন ও বহনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক সংশ্লিষ্ট থানাকে জানিয়ে ‘মানি স্কট’ সুবিধা নেওয়া। ছিনতাইকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে নজরদারিতে রাখা অথবা তাদের ছবি জনসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখা। অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকায় সিটি কপোরেশনের সমন্বয়ে আলোর ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন পার্ক ও দর্শনীয় স্থানে আকস্মিক অভিযান চালানো। ছদ্মবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রাখা।
দুই ধরনের ছিনতাইকারী নিয়ে বিপাকে পুলিশ
শিক্ষার্থী ও গাড়িচালকরা ভয়াবহ ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের শনাক্ত ও আটক করার ক্ষেত্রেও বিপাকে পড়ছে পুলিশ। বিমানবন্দর এলাকাকেন্দ্রিক কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার নামে ছিনতাই করে তাদের রাস্তার পাশে ফেলে যাচ্ছে। অনেক সময় হত্যার ঘটনাও ঘটছে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছিনতাই বাড়ছে। হল ও হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিনতাইয়ে জড়িতদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। এ ছাড়া রাতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করা শিক্ষার্থীদের তল্লাশির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ঢাকায় ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় পুলিশ টহল বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তার পরও ছিনতাইকারীরা সুযোগ সন্ধানে থাকে। তারা সুযোগ পেলেই দু-একটি ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে টাস্কফোর্স গঠনের পর ছিনতাই ঠেকাতে নতুন কর্মকৌশলের সুফল নগরবাসী পেতে শুরু করেছে। সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।